(আমাদের
কারাবন্দী ভাই তারিক মেহান্নার যে কয়টা অসাধারণ লেখা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে
এবং নিজের ঈমানের ব্যাপারে চিন্তিত করেছে এই লেখাটি তার একটি। আজ সকালে এক
দ্বীনি ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন তিনি যার কাছ
থেকে দ্বীনের দাওয়াহ পেয়েছিলেন সেই ভাইটিই আর দ্বীনের উপর নেই! এরকম
ব্যাপার খুবই সাধারণ। হঠাৎ করে দ্বীনে আসা, হঠাৎই আবার দ্বীন থেকে বেরিয়ে
যাওয়া, দ্বীনের উচ্চমার্গীয় বিষয় নিয়ে মাতামাতিতে লিপ্ত থেকে দ্বীনের মূল
আবেদন থেকে দূরে সরে যাওয়া, নিজের ভেতর ইসলামকে ধারণ করতে না পারা এরকম
অনেক কারণে আমাদের অনেক ভাই বোন দ্বীন প্র্যাকটিস করা ছেড়ে দেন জীবনের একটা
সময়ে গিয়ে। যা খুবই দুঃখজনক এবং হতাশার। সেরকম একটা গুরুত্বপুর্ন ইশ্যু
এবং তার জন্য কিছু উপদেশ নিয়ে তারিক মেহান্নার এই লেখা। আপনাদের কাছে আমার
আন্তরিক চাওয়া থাকবে আপনারা লেখাটা পড়বেন এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন
এবং অবশ্যই উপদেশগুলো মানার চেষ্টা করবেন ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ আমাদের ভাই
তারিক মেহান্নাকে জালিমের কারাগার থেকে মুক্ত করুন। ইসলামের জন্য আমাদের এই
ভাই যে ত্যাগ আর কষ্ট সহ্য করে চলেছেন তার বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জান্নাতুল
ফেরদৌস দান করুন। আমীন।)
দ্বীন ত্যাগের মাধ্যমে একজন মানুষ
চিরকালের জন্য জাহান্নামের অভিশপ্ত স্থানে ঠাঁই করে নেয়, যদি নাসে মৃত্যুর
পূর্বে তাওবা করে। দ্বীন ত্যাগ করলে ক্ষতি আর কারো নয়, ক্ষতি তার
নিজের।রাসুলুল্লাহ্ [সাঃ] –এর সময় এমন মানুষও ছিলো যারা তাঁকে [সাঃ]সরাসরি
দেখেছে, তাঁর [সাঃ] কথা শুনার সৌভাগ্য লাভ করেছে, তাঁর [সাঃ] সাথে চলাফেলা
করেছে, তাঁর [সাঃ] পেছনে সালাত আদায় করেছে, এমনকিএদের মধ্যে কেউ কেউ কুরআন
লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেছে – কিন্তু এরপরেও তাদের কেউ কেউ
মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল।
সুতরাং এরকম সামান্য কোনো ব্যক্তি ইসলামে থাকলো কী থাকলো না – তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এতে আমাদের লাভ বাক্ষতি কিছুই হয় না।
ইসলাম ছেড়ে চলে যাবার কারণগুলো নিয়ে এই
স্বল্প পরিসরে আলোচনা করাটা বেশ কঠিন, কিছু কিছু ব্যাপার ব্যক্তিগতও বটে।
কিন্তু আমি এতোটুকু বলবো যে – এক ধরনের শুষ্ক ইসলাম পালন করার ফলে এই
পরিণতি ঘটে।এই বিশেষ ধাঁচের ইসলামচর্চায় ইবাদাত আর আত্মশুদ্ধির জন্য সময়
থাকে না। মূল মনোযোগ থাকেখবর পড়ায় আর বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক করায় । ফলে,
রিদ্দা বা দীনত্যাগ তারই অবশ্যম্ভাবীফল।
এই ধারার মানুষদেরলেখাগুলোতে আবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, দেখবেন আমি ঠিকই বলছি।
আমরা অনেক সময় কোন ব্যাক্তির বিপ্লবী
কথাবার্তা শুনে তাকে “ভালো দ্বীনি ভাই”ভাবা শুরু করি, তখন এমনটা হতে পারে
যেআমরা তার বিদ্রোহী চেতনাকে দ্বীনের প্রতি আন্তরিক উৎসাহ ও নিষ্ঠা বলে ভুল
করছি। প্রকৃতপক্ষেএমনটা হতে পারে যে ঐ ব্যক্তির জন্য ইসলাম হল শুধুমাত্র
“এই মাসের স্পেশাল অফার”।
এরকম হওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো – তার
কথাবার্তা ও দ্বীনি পড়াশোনার মাঝে অন্তর কোমলকারী বিষয়সমূহের নগণ্য
উপস্থিত।কখনোই নাফল ইবাদাত না করা এবং ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ, একটি
পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা,একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা হিসেবে অনুধাবন করার চেষ্টা
না করাও এর অন্তর্ভূক্ত।
এই ধরনের মানুষগুলোকে শুধুমাত্র বিতর্কিত
এবং আমোদজনক বিষয়গুলো নিয়ে তর্কে মেতে থাকতে দেখা যায়। কারণ শুধুমাত্র
স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাকি সবার চাইতে আলাদা প্রমাণ করার
আকাঙ্ক্ষা থেকেইএই মানুষগুলো ইসলামে প্রবেশ করে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া
তা’আলার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে নয়।
তারা পুরোনকথা শুনতে আগ্রহ পায় না, সবসময়
নতুন কিছুর জন্য অস্থির হয়ে থাকে। শতকরা ৯৯ ক্ষেত্রেএটাই তাদের ইসলামের
ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠার কারণ। এই ধরনের লক্ষণগুলো অন্য যাদেরমধ্যে দেখা
যায় তাদেরকে নিয়েও আমার ভয় হয়। খুব বেশী দেরীহয়ে যাবার আগেই নিজে রক্ষা
করুন। দ্বীনের মাঝেবিতর্ক আর বিনোদন খোঁজা বন্ধ করুন। আল্লাহ্ সুবহানাহু
ওয়া তা’আলার সম্পর্কেজানতে, তাঁর সম্পর্কে সচেতন হতে চেষ্টা করুন । চেষ্টা
করুন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে নিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
কারো কারো কাছে হয়তো এটা একঘেয়ে,
বিরক্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই আপনাকে রক্ষা করবে।সবসময়
বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না, এবং তার বদলে প্রতিদিন চোখ বোলানোর
জন্য নিচের বইগুলোকে আপনার টেবিলে স্থান দিন:
- আল কুরআন
- রিয়াদুস সালেহীন,ইমাম নববী
- আল আদাব আলমুফরাদ, আল বুখারী
- আয যুহদ,ইমাম আহমাদ
এই বইগুলো শুধুশুধু লেখা হয়নি। এই
সিলেবাসটি নিয়মিত ধরে রাখার চেষ্টা করুন। এগুলো নিয়মিত পড়লে আপনার হৃদয়ের
চারপাশে একটি দুর্গ গড়েউঠবে। যখন ফিতনার আঘাত আসবে তখন এই দুর্গই আপনাকে
রক্ষা করবে। এবং নিশ্চিত থাকুন আজহোক, কাল হোক, ফিতনার এই আঘাত এক সময়
আসবেই।
রাসূলুল্লাহ[সাঃ] এর একটি হাদীস আছে যা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য -
ইয়াহইয়া ইবনুআইয়ুব, কুতায়বা ও ইবনু হুজর
(রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:
“অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসার আগেই তোমরানেক আমলের প্রতি অগ্রসর হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে। বিকালেমুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করেবসবে।”
[ ইসলামিক ফাউন্ডেশন| সহীহ মুসলিম | অধ্যায়ঃ ১| কিতাবুল ঈমান | হাদিস নাম্বার: 214 ]
আমরা অত্যন্ত কঠিন এক সময়ে বসবাস করছি। এই
সময়ে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে রাখা জ্বলন্ত কয়লা আঁকড়ে ধরে রাখারমতো – এরকম আরো
অনেক কিছুই আমি বলতে পারি,কিন্তু এগুলো আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন।
আমাদের মূল সমস্যা হল, আমাদের ঈমান ও
দ্বীনকে দৃঢ় করার যে ধীর, ক্লান্তিকর এবং কঠিন পথটি আছে,তা আমরা পাশ কাটিয়ে
যেতে চাই। অথচ এই পথটিই আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবে।আমাদের
শক্তিশালী করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জন্য যে পরীক্ষা
রেখেছেন তাঁর জন্য আমাদেরপ্রস্তুত করবে ।
ইসলাম প্রকৃতপুরুষদের দীন।এই দ্বীন সংগ্রামেরদ্বীন।অধ্যবসায়েরদ্বীন ।ধৈর্যের দ্বীন।এবং পরীক্ষারদ্বীন।
আপনি অবশ্যইপরীক্ষিত হবেন – এবং একজন
প্রকৃত পুরুষ মাত্রই ভালো মন্দসকল অবস্থা নির্বিশেষে আল্লাহর আনুগত্যে
অবিচল থাকতে পারে। আর যারা নামকাওয়াস্তে আল্লাহরইবাদাত করে, তারা বিপদের
প্রথম আভাস পাওয়া মাত্র চাপের মুখে নতি স্বীকার করে।
এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল,
আমাদের কারো কারো মনে আমাদের অজান্তেই এক ধরনের গোপন অহংকার কাজ করে। দৃঢ়,
স্থির সংকল্প হবার জন্য আমরা আমাদের নিজেদের ওপরই ভরসা করি এবং ভাবতেশুরু
করি আমরা বর্তমানে ‘ইলম, আক্বীদাহ, ঈমানের যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছি সেটা
সম্ভব হয়েছে আমাদের নিজেদের চেষ্টার মাধ্যমেই। আমি এরকম অসংখ্য ভাইকে
দেখেছি, যে তাঁরা কখনো দ্বীন অথবা সুন্নাহ ছেড়ে দেবেন আমি তা কখনো কল্পনাও
করিনি– কিন্তু তাই হয়েছে। এবং এরকম হবার মূলকারণ আমাদের এই ধরনের
চিন্তাধারা।
প্রকৃত সত্যএই যে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া
তা’আলাই আপনাকে এই দ্বীন, এই ঈমান দান করেছেন– এবং এটাই শেষ কথা। কিন্তু
যখন আপনি নিজেরউপর ভরসা করা শুরু করবেন, এবং দ্বীন পালন করতে সক্ষম হবার
জন্য গোপনে নিজেকে কৃতিত্বদেওয়া শুরু করবেন - তখন আল্লাহ আপনাকে আপনার
নিজের রাস্তাতেই ছেড়ে দেবেন। আর নিজের দৃঢ়তা, স্থির সংকল্পতার জন্য যখন
আপনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন – তখন শেষ পর্যন্ত তিনিও আপনার সাথে
থাকবেন।
এই কারনেই রাসুলুল্লাহ[সাঃ] সব চেয়ে বেশী
যে দুআটি করতেন তা হলো, "ইয়া মুক্বলিব্বাল ক্বুলুব, ছাব্বিত ক্বলবি 'আলা
দ্বীনিক" - আল্লাহ যেন তাঁর [সাঃ] হৃদয়কে দ্বীনের ওপরদৃঢ় রাখেন। ঈমানের
প্রশ্নে আমরা সকলেই আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভরশীল। আমি নিশ্চিতভাবেবলতে
পারি, অনেকেই আন্তরিকভাবে নিয়মিত এই দুআ করেনি। তারা তাদের অন্তরের এই গোপন
অহঙ্কারআর ঔদ্ধত্যের কারণেই এই অবস্থায় [রিদ্দা] উপনীত হয়েছে।
এবং শেষ পর্যন্তপ্রত্যেক মুরতাদের
পরিবর্তে এক হাজার নও মুসলিম ইসলামে প্রবেশ করে। যেইদিন আমরা নিশ্চিতহলাম
যে এক ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করেছে, সেই একইদিনে আমি মসজিদে বসে ৫৫ বছর বয়স্ক
একজনহিস্পানিক ব্যক্তিকে শাহাদাহ গ্রহন করতে দেখেছি।
তাই মনে রাখবেনযখন কেউ মুরতাদ হয়ে যায় –তখন যা ক্ষতি হবার তার পুরোটাইতার – আমাদের না।
আমাদের কাজহলো আমাদের হৃদয়গুলোকে দূর্গে
পরিণত করা। কারণ যে বৈরী ও কষ্টকর সময়ে আমরা বসবাস করছিএবং সামনে যে ফিতনা
আসছে– এটিই হল তার মোকাবেলা করার একমাত্র উপায়।