পৃষ্ঠাসমূহ

বিভক্তি ও ঐক্যের মূলনীতিঃ কারণ ও ফলাফল


আল্লাহ বলেন যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা মতভেদ করেছিল শুধুমাত্র পারস্পারিক হিংসা ও বিদ্বেষের কারণে, তাদের নিকট সুস্পষ্ট জ্ঞান আসার পরেও এখানে বলা হচ্ছে যে তারা মতভেদ করে ছিল তাদের নিকট এই জ্ঞান আসার পরেই যে, তাদের কি করা উচিত বা কি এড়িয়ে চলা উচিত। বস্তুত আল্লাহ কাউকে বিপথগামী করেন না যতক্ষন না তাকে সুস্পষ্টভাবে বলে দেন তার কি করা উচিত। এখানে বলা হয়েছে যে, তারা মতভেদ করেছিল শুধু মাত্র হিংসা-বিদ্বেষের কারণে। আল-বাগীমানে হল সীমালঙ্ঘন করা, এ ব্যাপারে ইবন উমার রাযিঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “হিংসা ও ঔদ্ধত্ত্বতখনই শুরু হয় যখন ইজতিহাদ হয় ইলম ব্যতীত। কোন স্বীকৃত মতভেদকে আল-বাগী বলেনা যা সাধারণত দুজন স্কলারের মাঝে হয়ে থাকে। আল-বাগী মানে হল প্রত্যাখ্যান করা বা সত্যকে অস্বীকার করা বা সীমালঙ্ঘন করা। আর সীমালঙ্ঘন করা হয় সাধারণত কোন আবশ্যকীয় কাজকে বাদ দেয়ার মাধ্যমে বা কোন নিষিদ্ধ কাজ করার মাধ্যমে।আর এটা জানা কথা যে এই গুলোর ফলেই বিভক্তি ও অনৈক্য শুরু হয়।


এর একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে এখানে, আল্লাহ তায়ালা আহলে কিতাবদের সম্পর্কে বলেন আর যারা বলে -- 'নিঃসন্দেহ আমরা খ্রীষ্টান’, তাদের থেকে আমরা তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম, তারাও ভু লে গেল তাদের যে-সব নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তার অংশবিশেষ, কাজেই আমরা তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখলাম কিয়ামতের দিন পর্যন্ত।”[৫:১৪] সুতরাং আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে তাদের কপালে পারস্পারিক ঘৃণা ও শত্রুতা লিখে দেওয়া হয়েছিল এজন্য যে তাদের যে আদেশ দেওয়া হয়েছিল তার একটা অংশ কেবল তারা পরিত্যাগ করেছিল।

আমাদের ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যা ঘটে এবং বিভিন্ন দলের মদ্ধেও যা দেখা যায় তা হল তারা মৌলিক ও আনুষঙ্গিক সব বিষয়েই পরস্পর মতভেদ করে এবং এটা আলিম ও তাদের অনুসারীদের মদ্ধেও দেখা যায়এবং উভয় দলের মাঝে একটা বিষয়ে মিল পাওয়া যায় তা হল তারা একে অন্যকে বলে তারা আসলে ভ্রান্তিতে আছে
যেই সকল হকপন্থি ফিকাহবিদ দ্বীনের বাহ্যিক কাজের ব্যাপারে খুবই কঠোর এবং যেই সকল হকপন্থি সুফি দ্বীনের অন্তর্নিহিত ব্যাপারগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেন তারা একে অন্যের পথকে অস্বীকার করেন এবং বলেন ওরা তো ধর্মের মধ্যেই নাই এভাবে তারা একে অপরকে বাতিল ঘোষণার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পরে। আর এ সব কিছুই হয় শত্রুতা ও ঘৃনার কারণে।
এজন্যই আল্লাহ তায়ালা শরীরের পরিশুদ্ধির আদেশ যেমন দিয়েছেন তেমন আত্মা পরিশুদ্ধির ব্যাপারেও বলেছেন। উভয় বিষয়ের পরিশুদ্ধিই দ্বীনের মধ্যে আছে যা আল্লাহ তায়ালা ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন



 আল্লাহ্ চান না তোমাদের উপরে কষ্টের কিছু আরোপ করতে, কিন্তু তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে, আর যাতে তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপরে পরিপূর্ণ করেন, যেন তোমরা ধন্যবাদ দিতে পারো।”[৫:৬]


সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতাকে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন।”[৯:১০৮]


নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন।”[২:২২২]


আপনি তাদের মাল থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যাতে তা দিয়ে আপনি তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন”[৯:১০৩]


এরা এমনিই যে, আল্লাহ এদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না”[৫:৪১]


বস্তুতঃ মুশরিকরা তো অপবিত্র।”[৯:২৮]


তাই আমরা দেখি যে কোন কোন ফিকাহবিদ ও তাদের অনুসারীদের একমাত্র চিন্তায় বিষয় হল শারীরিক পরিশুদ্ধি এবং এই ক্ষেত্রে তারা শরীয়তের সীমা অতিক্রম করে গেছে এবং পরিত্যাগ করে গেছে আত্মার পরিশুদ্ধির বিষয়টি যে ব্যাপারে তাদের পুনঃপুনঃ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা  শারীরিক পরিশুদ্ধির বাইরে আর কিছুর পরিশুদ্ধিকে বুঝতেই চায় না। একইভাবে আমরা কোন কোন সুফিদের দেখি শুধুমাত্র আত্মার পরিশুদ্ধির ব্যাপারে চিন্তা করতে এবং এক্ষেত্রে তারা শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করে গেসে শরীরের পরিশুদ্ধির ব্যাপারটি উপেক্ষা করে।


সুতরাং প্রথম দলটি প্রচুর পানির অপচয় শুরু করে এবং এমন বিষয়কেও নাপাক বলতে থাকে যা আসলে নাপাক নয় এবং এমন বিষয় থেকেও দূরে থাকতে শুরু করে যে ব্যাপারে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এই কারণে তাদের ভাইদের ব্যাপারে তাদের দিলে ঘৃণা বিদ্বেষ অহংকার জমা হতে থাকে যা আসলে ইহুদীদের মধ্যে দেখা যায়। যে সকল বিষয় তাদের জন্য আবশ্যক করা হয়েছে সে ব্যাপারে অন্য দলটি এতই উদাসীন যে তারা অন্য দলটি নিজেদের অন্তর কে এতই নিরাপদ মনে করে যে তাদের জন্য যা আবশ্যক করা হয়েছে সে ব্যাপারেও তারা উদাসীনতা প্রদর্শন করে থাকে- যেমন খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে এবং ওইসব থেকেও যা অন্তরের জন্য ক্ষতিকর অর্থাৎ খারাপ কামনা বাসনাএই অজ্ঞতার কারণে তারা ভাল খারাপের মাঝে পার্থক্য করতে পারেনা। এ ক্ষেত্রে তারা খারাপ কামনা বাসনা থেকে মনকে বাচাতে পারে না। এর ফলে তারা আত্বশুদ্ধির জন্য এমন পন্থা বের করে যা আসলে খৃস্টানদের পথ।

সুতরাং দুই দলের মাঝে শত্রুতা শুরু হয় যা আসলে দ্বীনের কিছু অংশ পরিত্যাগ করার কারণে যা করতে তাদের আদেশ করা হয়েছিল। এটা হয় আল-বাগির কারণে- যার অর্থ হল সীমালঙ্ঘন করা বা সত্যকে অস্বীকার করা বা ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণে। সীমালঙ্ঘন কখনও কখনও মানুষের বেলায় ঘটে আবার আল্লহর অধিকারের বেলায়ও ঘটে- উভয় এর মধ্যে সীমালঙ্ঘন নিহিত। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষের কারণে”,  উভয় দলই পরস্পরের অধিকারকে সম্মান না করাতেই বাগীতে পরিনত হয় এবং শত্রুতা করা থেকে বিরত হয় না। আল্লাহ বলেন অপর কিতাব প্রাপ্তরা যে বিভ্রান্ত হয়েছে, তা হয়েছে তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরেই।”[৯৮:৪]

সকল মানুষ একই জাতি সত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকরী হিসাবে। আর তাঁদের সাথে অবর্তীণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুতঃ কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি; কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক জেদবশতঃ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল”[২:২১৩]


নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই”[৬:১৫৯]


সবাই তাঁর অভিমুখী হও এবং ভয় কর, নামায কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত”[৩০:৩১-৩২]


এই জন্য আল্লাহ মুশরিকদের ব্যাপারে বলেছেন তারা যাকেই পায় খোদা বানিয়ে পুজো করতে শুরু করে- তুমি যা বল তা মুশরিকদের নিকট খুবই ভারী মনে হয়

 “হে রসূলগণ, পবিত্র বস্তু আহার করুন এবং সৎকাজ করুন। আপনারা যা করেন সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত।আপনাদের এই উম্মত সব তো একই ধর্মের অনুসারী এবং আমি আপনাদের পালনকর্তা; অতএব আমাকে ভয় করুন”[২৩:৫১-৫২]

সুতরাং এটা পরিষ্কার যে ঐক্যের একমাত্র পথ হল দ্বীনের সব বিষয় গুলোর উপর পূর্ণভাবে আমল করা এবং শির্ক মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদাত করা অন্তর থেকে এবং বাহির থেকে।
আর অনৈক্যের পথ হল দ্বীনের কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়া যে বিষয়ে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সীমালঙ্ঘন করা অর্থাৎ আল-বাগী হওয়া।

ঐক্যের ফল হলঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফেরাত ও দয়া, বান্দার উপর তাঁর শান্তি বর্ষন, ইহকাল ও পরকালের জীবনে অনন্ত সুখ এবং কেয়ামতের দিন উজ্জ্বল চেহারা।
অনৈক্যের ফল হলঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি, তাঁর লানত, বিচার দিবসে কাল চেহারা এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শায়াফাত থেকে দূরে থাকা

এটা প্রমানিত যে যখন থেকে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে তখন থেকেই আল্লাহর হুকুম সমূহ পুরোপুরি মেনে চলা সহজ হবে আর তখনই তাদের উপর মাগফিরাত করা হবে। আর বিশ্বাসে বা কথায় বা কাজে এমন কিছু করা যা আল্লাহ বলেন  নি সে ক্ষেত্রে আল্লাহর কোন ওয়াদা নেই। সুতরাং এটা আল্লাহর হুকুম মানাও নয় আর এব্যাপারে আল্লাহর কোন মাগফরাতও নেই যদি কেউ আল্লাহ আদেশ করেননি এমন কোন কথা বলে বা এমন কোন কাজ করে। আত-তানবীহ কিতাবে শুরুতেই আবু বকর আল আজীজ এই বিষয়টিই এনেছেন।

মূল লেখাঃ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত