পৃষ্ঠাসমূহ

ইখতিলাফ বা অনুমতিযোগ্য বিষয়ে মতপার্থক্যের আদব।

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি 

এক মুসলিম ভাই অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে ইজতেহাদগত কোন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও কিভাবে সুসম্পর্ক রক্ষা করবে তার নির্দেশনায় ইসলাম চমৎকার আদর্শ স্থাপন করেছে তাদের জন্য যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরন করতে চায় । আল্লাহ্‌ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে রহমত হিসেবে পাঠানো  রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,“উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে ” (ইমাম বুখারীর আদাবুল মুফরাদ,২৭৩ ; শাইখ আলাবানীর মতে সহীহ)।



মতপার্থক্যগত বিষয়ে একে অপরের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে আদাবসমুহ :

১- নিজের করা ভুল পরিশুদ্ধের ক্ষেত্রে অপর ভাইয়ের দেয়া উপদেশ সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহন করা এবং এটা জেনে রাখা যে শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্যই আমাকে এই আন্তরিক উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং তা আমার জন্য আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে উপহার স্বরূপ । আমাদের জানা উচিত যে, সত্যকে প্রত্যাখান করা এবং উপদেশে রাগান্বিত হওয়া প্রকৃতপক্ষে অহংকারের কারনেই হয়ে থাকে । আল্লাহ্‌ আমাদের অহংকার থেকে হেফাজত করুন । সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং অন্য মানুষ কে ভৎসনা করাই হচ্ছে অহংকার” (মুসলিম হাদীস নং, ৯১)

মতপার্থক্য থাকলেও আলোচনার সময় একে অপরের সাথে উত্তম আচরনের অনেক উদাহরণ আমাদের পূর্ববর্তী নেককার সালফে সালেহীনগন আমাদের জন্য রেখে গেছেন এবং বর্ণনা করে গেছেন ; আল হাফিয ইবন আব্দুল-বার বলেন : আমাকে কিছু লোক জানালো যে আবু মোহাম্মদ কাশিম ইবন আসবাগ বলেছেন   : যখন আমি পূর্ব দিকে যাত্রা করেছি, তখন আমি আল-কাইরাওআন নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করি এবং বাকর ইবন হাম্মাদ এর কাছ থেকে মুসাদ্দাদের হাদীসটি গ্রহন করি ।এরপর আমি বাগদাদের দিকে যাত্রা করি এবং লোকদের সাথে মিলিত হই । যখন আমি ফিরে আসি তখন মুসাদ্দাদের হাদিসটা শেষ করার জন্য বাকর ইবন হাম্মাদের কাছে পুনরায় যাই । একদিন আমি তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস পড়ে শুনাই যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ আমার কাছে মুদার থেকে একজন লোক এসেছে রং-বেরঙের পশমি (মুজতাবি আন নিমার,mujtaabee an-nimaar) জামা গায়েহাদিসটি শুনে বাকর ইবন হাম্মাদ বলেন এটা মুজতাবি আথ থিমার (mujtaabee ath-thimaar)হবে তখন আমি উত্তর দিলাম আন্দালুস এবং ইরাকের যাদের কাছে আমি হাদিসটি পড়েছি মুজতাবি আন নিমার(mujtaabee an-nimaar) এভাবেই পড়েছি । 

 তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি ইরাকে প্রবেশ করে, আমাদের সাথে মতপার্থক্য করে আমাদের বিরুদ্ধে উদ্ধত প্রকাশ করছ । অতপর তিনি বললেন ওঠো এবং আমাদের সম্মানিত উস্তাদের কাছে চল যিনি মাসজিদে আছেন এবং তিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ । সুতরাং আমি তার সাথে গেলাম এবং আমরা উস্তাদের কাছে এ ব্যাপারটা জানালাম, উস্তাদ উত্তর দিলেন : এটা মুজতাবি আন-নিমার(mujtabee an-nimar) ই হবে যেমন তুমি বলেছ । তারা রং-বেরঙের পশমি পোশাক পড়ত যার পকেট থাকত সামনে এবং নিমার(nimaar) হচ্ছে নিমরাহ(nimrah) এর বহুবচন । তখন বাকর ইবন হাম্মাদ তার নাক ধরে বলতে লাগলেন, সত্যের সামনে আমার নাক অধঃপতন হয়েছে, সত্যের সামনে আমার নাক বিনয়ী হয়েছে এবং তিনি প্রস্থান করলেন ।[ মুখতাসার জামি বায়ানুল-ইলম ওয়া ফাদলিহি(প.১২৩), সংক্ষিপ্ত শাইখ আহমাদ ইবন উমর আল-মুম্মাসসানি]

হে আমার প্রিয় ভাই, শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্যই বলছি তুমি কি সত্য স্বীকারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার এই অসাধারণ উদাহরণ দেখো না, আল্লাহ্‌ তোমাকে হেফাজত করুন । সত্য স্বীকারের সহনশীলতার প্রয়োজন আজ আমাদের সবচেয়ে বেশি নয় কি ? যদিও এটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাদের ইখলাস তথা নিয়তকে বিশুদ্ধ করে । ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ বলেন,

আমাদের সময়ে ন্যায়পরায়ণতার চেয়ে দুর্লভ আর কিছুই নেই ।”(মুখতাসার জামি বায়ানুল-ইলম ওয়া ফাদলিহি(প.১২০) । 

তাহলে একবার ভেবে দেখি আমাদের বর্তমান সময়ের কি অবস্থা যখন চারিদিকে মিথ্যা কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ ? আমরা আল্লাহ্‌র কাছে পথভ্রষ্ট হওয়ার থেকে পানাহ চাই ।

২- যখন তুমি তোমার অপর ভাইয়ের সাথে কথা বলবে বা কোন বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে তখন অবশ্যই সুন্দর, নম্র এবং সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করবে । মহান আল্লাহ্‌ সুবানাহুওয়াতায়ালা বলেন,
এবং মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো । সুরা আল-বাকারা ২, আয়াত ৮৩ । 

আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 “কিয়ামতের দিন বিশ্বাসীদের নেকির পাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে ভারী আর কোন কিছুই থাকবে না । প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌ ঘৃণা করেন অসৎ ও মন্দভাষী মানুষদের ।”(আবু দাউদ হাদীস নং ৪৭৯৯, আল হাফিজ ইবন হাজার এর মতে সহীহ, বুলগুল-মারাম,১৫২৩)

৩- তুমি তোমার অপর ভাইয়ের সাথে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে যা উত্তম এবং যথাযথ । এক্ষেত্রে তোমার জন্য দিকনির্দেশনা হচ্ছে তুমি আলোচনা করবে অবশ্যই সত্য এবং শুদ্ধিকরনের জন্য, তোমার অহংকার বা আত্মমর্যাদাবোধকে বিজয়ী করার জন্য আলোচনা করবে না, কারন অহংকার পাপের দিকে ধাবিত করেতোমার আচরন হবে এমন যে, তুমি যা বলবে তা একান্ত আন্তরিকভাবে ইখলাসের সাথে বলবে । যদিও বা তোমার অপর ভাইয়ের সাথে আলোচনার কোন বিষয় নিয়ে বিতর্কের সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন তাকে সালাম দিয়ে সম্ভাষণ জানাবে আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস মনে করিয়ে দেবে । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের প্রান্তদেশে একটি বাড়ির জিম্মাদার যে ব্যক্তি যুক্তিতর্ক পরিত্যাগ করে যদিও সে জানে সেই সঠিক ।” (আবু দাউদ হাদীস নং ৪৮০০, শাইখ আলাবানীর মতে সহীহ, ২৭৩)।

আল-হাফিদ ইবন আব্দুল বার বর্ণনা করেন যে যাকারিয়া ইবন ইয়াহইয়া বলেন : আমি আল-আসমায়িকে বলতে শুনেছি তিনি বলেনআব্দুল্লাহ ইবন হাসান বলেছেন 

 যুক্তিতর্ক বন্ধুত্বে ফাটল ধরায় এবং কঠিন সম্পর্কের বাঁধন ও খুলে ফেলে । যুক্তিতর্ক সর্বনিম্ন যে ক্ষতি করে তা হল বিবাধ সৃষ্টি করা আর বিবাধ ধাবিত করে সম্পর্ক ছিন্নের দিকে ।

জাফর ইবন আওফ বলেন, আমি মিসার কে বলতে শুনেছি যখন সে তার পুত্র কিদাম কে উদ্দেশ্য করে বলছিল : আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি হে প্রিয় কিদাম, মনোযোগ দিয়ে শোন একজন পিতার কথা যে তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল । তুমি হাসি-তামাশা এবং যুক্তিতর্ক পরিহার কর । হাসি-তামাশা এবং যুক্তিতর্ক  শত্রুর ন্যায়, এদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না আমি হাসি-তামাশা এবং যুক্তিতর্কের ভিতর প্রশংসাযোগ্য কিছুই পাই নি । হাসি-তামাশা এবং যুক্তিতর্ক ভালো প্রতিবেশীও নয়, এমনকি ভালো বন্ধুও নয় । ”(মুখতাসার জামি বায়ানুল-ইলম ওয়া ফাদলিহি(প.২৭৮)।

পূর্ববর্তী নেককার সালফে সালেফীনগণ মতপার্থক্যের ক্ষেত্রেও কিভাবে আদব রক্ষা করে সুন্দর ব্যবহার করতে হয় তার অসাধারণ সব উদাহরণ আমাদের জন্য  রেখে গেছেন । এরকম একটি উদাহরণ যা বুখারী(হাদীস নং-৫৭০৪) ও মুসলিমে (হাদীস নং-২২০) উল্লেখ আছে, ইবন আব্দুর-রহমান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,“ আমি সাদ ইবন যুবাইর এর সাথে ছিলাম । তখন সাদ জিজ্ঞেস করলেন :  তোমাদের মধ্যে কে গতরাতে উল্কা দেখেছ । আমি উত্তর দিলাম, আমি দেখেছি । এরপর আমি বললাম এটা এ কারনে না যে আমি তখন সালাত আদায় করছিলাম বরং আমি বিচ্ছুর তীঘ্ন দংশনে যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম । তিনি বললেন :  তখন তুমি কি করছিলে ? আমি উত্তর দিলাম :  আমি ঝাড়-ফুক করছিলাম তিনি বললেন :  কেন তুমি এমনটি করেছ ? আমি উত্তর দিলাম কারন আস-শাহবী থেকে এ মর্মে আমার নিকট একটি হাদীস জানা আছে । তিনি বললেন আস-শাহবী কি বর্ণনা করেছে ? আমি উত্তর দিলাম আস-শাহবী, বুরাইদা ইবন আল-হুসাইন থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
কু-নজর বা তীঘ্ন কিছুর দংশন ছাড়া কোন ঝাড়-ফুক নেই ।
সাদ ইবন যুবাইর বলেন বুরাইদা ইবন আল-হুসাইন চমৎকারভাবে তার জ্ঞানকে ধরে রেখেছে । যদিও ইবনে আব্বাস আমাদের কাছে হাদিসটি এভাবে বর্ণনা করছেন অতপর তিনি হাদিসটি বর্ণনা করেন ।

লক্ষ্য করে দেখুন মহিমান্বিত আচরণের কি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, সাদ ইবন যুবাইর যে কিনা ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছে । সাদ ইবন যুবাইর, ইবন আব্দুর-রহমান এর প্রতি কঠোর নয় বরং নম্র আচরন করেছেন কারন ইবন আব্দুর-রহমান প্রমাণের ভিত্তিতে আমল করছেন । অতপর সাদ ইবন যুবাইর তাকে ব্যাখা করলেন কোনটি উত্তম, এবং অবশ্যই তা করলেন প্রমাণের ভিত্তিতে সুন্দর নম্র ভাবে সংশোধনের উদ্দেশ্যে । 

মূল লেখাঃ শাইখ সালেম ইবন সালিহ আল-মারফাদি 

অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত