প্রশ্নঃ
আজকের যুগে আমরা দেখতে পাই যে পাশ্চাত্য আমাদের থেকে অনেক
বিষয়েই বেশ এগিয়ে গেছে, কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ “হে বানী
ইসরাইল! আমি তোমাদেরকে যে নিয়ামত দান করেছি তা স্মরণ কর এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে
সমগ্র পৃথিবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি” [আল-বাক্বারা ২:৪৭]। আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধরদের উপর এই যে রহমত
বর্ষণ করলেন তা কি আমাদের এই যুগে রহিত হয়ে গেছে নাকি তা পুনরুত্থান দিবসের আগ পর্যন্তই
চলবে? যদি রহিত হয়ে গিয়ে থাকে তবে কেন পশ্চিমারা আজ আমাদের থেকে এত বেশি এগিয়ে?
আমাদের আরবদের কোন যোগ্যতাটার অভাব? চিন্তা, আবিষ্কার ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে
পশ্চিমাদের থেকে এগিয়ে যেতে কীসে আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছে
উত্তরঃ
একটা জাতির
ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুধুমাত্র কিছু বাহ্যিক ব্যাপারকেই আমলে আনা ন্যায্য
নয়। কারণ সাংস্কৃতিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যেখানে অনেকগুলো বিষয়ই উপাদান
হিসেবে কাজ করে। এই উপাদানগুলো বহু বছর ধরে পুঞ্জীভূত হয়ে এবং মানুষের জীবনের
প্রতিটি অংশে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার পরই কেবল সমাজের অবস্থা একটু একটু করে উন্নত
হয়। মানুষের পক্ষে এই উন্নতি আঁচ করা কঠিন কারণ এটা ঘটে ভোরের আলো ফোঁটার মত করে;
দিগন্তে ছড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ক্রমেক্রমে বাড়তে থাকে।
পার্থিব
উৎকর্ষের কিছু কিছু দিক নিয়ে পবিত্র কুরআন আমাদের বলে যে এগুলো ছিল তখন (এখনও)
আল্লাহর পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যম। এই পরীক্ষাগুলো
নেওয়ার পেছনে আল্লাহর যে প্রজ্ঞা এবং যেভাবে এগুলো ইতিহাসের গতিময়তাকে
প্রভাবিত করে, তা মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বোঝে না।
আল্লাহ রব্বুল
‘আলামীন বলেনঃ
“যেদিন
অবিশ্বাসীদেরকে জাহান্নামের উপর দাঁড় করানো হবে। (সেদিন তাদেরকে বলা হবেঃ) তোমরা
তো পার্থিব জীবনে পূর্ণ সুখ-শান্তি ভোগ করে নিয়েছ; সুতরাং আজ তোমাদেরকে দেয়া হবে
অবমাননাকর শাস্তি, তোমরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করেছিলে এবং তোমরা ছিলে
পাপাচারী।” [আল-আহক্বাফ ৪৬:২০]
“তারা কি
পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখত যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কেমন হয়েছে।
শক্তিতে তারা ছিল তাদের অপেক্ষা প্রবল, তারা জমি চাষ করত, তারা ওটা আবাদ করত তাদের
অপেক্ষা অধিক। তাদের নিকট এসেছিল তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ; বস্তুতঃ তাদের
প্রতি জুলুম করা আল্লাহর কাজ ছিল না, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম
করেছিল।
অতঃপর যারা মন্দ
কর্ম করেছিল তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ; কারণ তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান
করত এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত।” [আর-রূম ৩০:৯-১০]
আল-আল্লামা
মুহাম্মাদ রাশীদ রিদা (রহঃ) বলেছেনঃ
আল্লাহর
একত্ববাদে (তওহীদ) তাঁদের বিশ্বাস, আল্লাহর ব্যাপারে তাঁদের জ্ঞান, ভালোবাসা ও
আল্লাহর প্রতি তাঁদের আস্থাই প্রথমদিকের মুসলিমদের আত্মা পরিশোধিত করেছিল, তাঁদের
উদ্দেশ্য শাণিত করেছিল এবং দিয়েছিল শক্তি ও অহংবোধ। এর মাধ্যমে তাঁরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ
হয়েছিলেন এবং প্রেরণা পেয়েছিলেন দেশ দখল ও মানুষদের শাসন করতে, তাদের
আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে, অত্যাচারী রাজাদের থেকে
মুক্তি দিতে, সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে, এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন
শাখা পুনরুদ্ধার ও উন্নত করতে। তাঁদের সকল অর্জনই অভূতপূর্ব ছিল যেভাবে পৃথিবীর আর
কোন জাতিই কখনো পারেনি। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী গুসতাভ ই বন বলেছেনঃ তিন প্রজন্মের
আগে কোন অগ্রগামী জাতির পক্ষেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখার সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভ
সম্ভব নাঃ প্রথম প্রজন্ম অতীত নিয়েই পড়ে থাকে; দ্বিতীয় প্রজন্ম অন্ধ অনুসরণ থেকে
মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে; আর তৃতীয় প্রজন্ম স্বাধীনতা ও কঠোর পরিশ্রমের
মাধ্যমে সফলতার মুখ দেখে। (তিনি বলেছেন যে এটা সকল জাতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)
আরবদের ছাড়া; একমাত্র তারাই প্রথম প্রজন্মে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন
করতে সক্ষম হয়েছিল।
আমি বলিঃ এর
কারণ ছিল কুরআনের শিক্ষা যা তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং অন্ধ অনুকরণ করা বন্ধ
করতে শিখিয়েছিল। কুরআনই তাদের শিখিয়েছিল মানবজাতিকে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব ব্যাপারে
নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু ইসলামীয় খলিফার পতন ও আরব সভ্যতার সমৃদ্ধি থুবড়ে পড়ার পর
থেকে এর সবই পরের প্রজন্মগুলোতে হারিয়ে যায়। তখন শক্তি চলে যায় অনারবদের হাতে
যাদের কাছে ইসলামের কিছুই ছিল না; ছিল শুধু কিছু বাহ্যিক ঐতিহ্য যার কিছুই কুরআনের
শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।
তাফসীর আল-মানার
[১১/১৭৩]
আমাদের উম্মাহর
উপর যুগযুগ ধরে যে ষড়যন্ত্র চলছে তা উপেক্ষা করার মত নয় এবং এটাই আমাদের শত্রুদের
পার্থিব উন্নতিতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আমাদের ও আমাদের উম্মাহর চিন্তা পরাজয়
স্বীকারের মনোভাব নিয়েই পড়ে আছে যার ফলে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেও অন্যের উপর নির্ভর
করতে হচ্ছে এবং একটি অগ্রগামী জাতিতে পরিণত হবার ভীষণ দায়িত্বে আমরা ভারাবনত হয়ে
আছি। আর বানী ইসরাইলদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে
তারা প্রতিটা সুযোগেরই চমৎকারভাবে সদ্ব্যাবহার করেছে এবং প্রকৌশলের দিক দিয়ে
বৈশ্বিকভাবে প্রভাব ফেলতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। তারা দশকের পর দশক অবিরাম
চেষ্টা করে গেছে যতদিন না তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে আর এভাবেই আজকে তারা শক্তির
চরম শিখরে পৌঁছেছে। কিন্তু এর সাথে এই
আয়াতের কোন সম্পর্কই নেইঃ “হে বানী
ইসরাইল! আমি তোমাদেরকে যে নিয়ামত দান করেছি তা স্মরণ কর এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে
সমগ্র পৃথিবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি” [আল-বাক্বারা ২:৪৭], কারণ এই আয়াত তো শুধু ইতিহাসজুড়ে বাণী ইসরাইলদের যেসকল নিয়ামত
দ্বারা আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন তার কথাই বলে এবং তাদের এগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার
জন্যই এই আয়াতের অবতারণা। এসব অনুগ্রহের কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ “আর যখন
মূসা (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর
নিয়ামতকে স্মরণ কর,
যখন তিনি তোমাদের মধ্যে বহু নবী সৃষ্টি করলেন, আর তোমাদেরকে
রাজাধিপতি করলেন। আর তোমাদেরকে এমন বস্তুসমূহ দান করলেন যা বিশ্ববাসীদের কাউকেই
দান করেননি।” [আল-মায়িদা ৫:২০]
আল-হাফিজ ইবন
কাসীর (রহঃ) বলেছেনঃ
এখানে আল্লাহ,
সুউচ্চ যিনি, তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পূর্বের নিয়ামতসমূহের কথা যা তিনি তাদের
পূর্বপুরুষদের দান করেছিলেন, এবং সেই অনুগ্রহের কথা যে তিনি তাদের মধ্য থেকেই নবী
পাঠিয়েছিলেন, তাদের জন্য স্বর্গীয় বইগুলো পাঠিয়েছিলেন এবং সেকালে সকল জাতির চেয়ে
তাদের বেশি সামর্থ্য দান করেছিলেন।
[তাফসীর
আল-কুরআন আল-‘আজীম, ১/২৫৫]
তবে আমাদের
বর্তমান অবস্থায় আশাবাদী হওয়াটাই আমাদের সামনে এগিয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এবং
সফলতা এনে দিতে পারে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব দু’ভাবেই সবরকম সুযোগকে কাজে লাগানোর
মাধ্যমে। এর ভিত্তি হচ্ছে সেই ন্যায়নিষ্ঠ মানুষটি যে সবসময় মনে রাখে যে তাকে সকল
পরিস্থিতিতেই খেয়াল করছেন আল্লাহ, সুমহান ও মহিমান্বিত যিনি। এই মানুষগুলোই পরিবার
ও সমাজের সংস্কারসাধনে ভূমিকা রাখে; তারা সবকিছু সোনার প্লেটে সাজানোভাবে পাওয়ার
আকাঙ্ক্ষা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বরং তারা ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না
এবং সকল প্রকার ভাল ও উপকারী কাজে নিবেদিত হয় শুধুমাত্র আল্লাহর উপর এই বিশ্বাস
রেখে যে তিনি তাদের সকল কাজেই অনুগ্রহ করবেন সে যত ছোটই হোক আর তাদের ভাল কাজের
বিনিময়ে পুরষ্কার দেবেন। আল্লাহ, সুমহান যিনি, ভালই জানেন কে অনিষ্ট করতে চাচ্ছে
আর কে ভালো কাজ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, এবং তাঁর রসূলদের অনুসরণকারীরাই জয়ী হবে
যদি তারা এমন পথে চলে যা শুধু জয় ও উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ, মহিমান্বিত
যিনি, বলেনঃ
“তারা ভীষণ
চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের চক্রান্ত রক্ষিত হয়েছে। তাদের
চক্রান্ত এমন ছিল না যাতে পর্বত টলে যায়।
তুমি কখনো মনে
করো না যে, আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন; আল্লাহ
পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।” [ইব্রাহীম ১৪:৪৬-৪৭]
আল্লাহই সবচেয়ে
ভালো জানেন।
মূল লেখাঃ শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত
মূল লেখাঃ শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত