রহমান ও রহিম, দয়ালু আল্লাহ্ তায়ালার নামে
সংজ্ঞাঃ গাল ও গালের নিচের অংশে হওয়া চুলকে দাড়ি (আরবীতে লিয়াহ) বলা হয়। কপালের পাশে, নিচের ঠোঁটের আশপাশে, থুতনি ও চোয়ালে গজানো চুলও দাড়ির অনর্ভুক্ত।
দাড়ির ব্যাপারে ইসলামের বিধান
যাদের দাড়ি উঠেছে, তা রাখা তাদের জন্য ওয়াজিব (অবশ্য
কর্তব্য)। সুন্নাহ য় দাড়ির ব্যাপারে পর্যাপ্ত উদাহরণ রয়েছে (নিচে দেয়া হবে) এবং
উলামাগন সকলেই এ ব্যাপারে একমত। তাই এখনকার কিছু নতুন নজরে আসা শাইখদের দুর্বল
ফতওয়া শুনে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। কেননা এরা এ কাজটি নিজেদের লাভের জন্যই
করছে। আর এটা করে তারা মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে ভুল পথে। যখন রাসুল (সা) বলেছেন-
"যে কোন ভাল কাজ শুরু করে, সে পুরস্কার পাবে।
সাথে সাথে যারা তার অনুসরন করে তাদের কাজের সমান সওয়াবও রবে তার জন্য। আর যে খারাপ
কোন কাজ শুরু করে সেটার বোঝা তাকেই বইতে হবে। সাথে সাথে তাদের কাজের বোঝাও যারা
তার অনুসরন করে একই কাজ করেছে।" [মুসলিম]
তিনি আরও বলেন:
"আল্লাহ্ এমনি এমনি মানুষের হৃদয় থেকে জ্ঞান ( সঠিক বিচার-বুদ্ধি, বোধ, বিচক্ষনতা,
প্রজ্ঞা, ধৈর্য, দূরদর্শিতা) উঠিয়ে নেন না, বরং তিনি জাতির জ্ঞানী লোকদের মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষকে এ নিয়ামত থেকে
বঞ্চিত করেন। যখন কোন আলেম-ই অবশিষ্ট থাকেন না, মানুষ তখন মূর্খদের তাদের নেতা বানায়। এরা তখন না জেনেই ধর্মের নামে
লোকদের বানিয়ে কথা বলে, উপদেশ দেয়। আর এটা করে তারা
নিজেরা ভুল পথে যায়, অন্যদেরও সে পথে নেয়।"
সীমালঙ্ঘনের কয়েকটি উদাহরণ
কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী দাড়ি শেভ করার ফলে অনেকগুলো ইসলামিক বিধানের লঙ্ঘন
হয়। নিচে তার কিছু তুলে ধরা হল।
১। আল্লাহ্ তায়ালার অবাধ্যতা
দাড়ি শেভ করার ফলে আল্লাহ্র সাথে নাফরমানি করা হয়। পারস্যের অধিপতি কিসরা
নিযুক্ত ইয়েমেনের শাসক একবার মুহাম্মদ (সা) কে ডেকে পাঠিয়ে দুজন দূত তাঁর কাছে
প্রেরন করল। যখন তারা মুহাম্মাদ (সা) এর সামনে
এল, দেখা গেল তাদের দাড়ি শেভ করা এবং মোচ রাখা। তাদের
চেহারা এতই খারাপ লাগছিল যে তিনি তাদের দিকে তাকালেনই না। আর বললেন – তোমাদের উপর দুঃখ আসুক, কে তোমাদের এমন করতে
বলেছে? তারা বলল – আমাদের প্রভু
(কিসরা)। মুহাম্মাদ (সা) তখন বললেন –
আমার সম্মানিত ও মর্যাদাবান রবের শপথ, তিনি আমাকে আদেশ
করেছেন দাড়ি ছেড়ে দিতে আর মোচ ছোট রাখতে।
২। রসুল (সা) এর অবাধ্যতা
দাড়ি শেভ করলে রাসুল (সা) এর আদেশ অমান্য করা হয়। অনেকগুলো হাদিসে তিনি (সা) পুরুষদের দাড়ি ছেড়ে দেবার ব্যাপারে আদেশ
করেছেন। কথা ভিন্ন হলেও হাদিস গুলোর মর্মার্থ একই।
মোচ ছেঁটে আর দাড়ি ধরে রাখ। [বুখারী ও মুসলিম]
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রাসুল (সা)
এর কথা মত চলা মানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথা মত চলা।
আল্লাহ বলেন (যার মানে) –
যে
রাসুল (সা) কে মেনে চলে, সে
আল্লাহকেই মেনে চলে। [আন-নিসা ৪:৮০]
৩।
রাসুল (সা) এর দেখানো পথ ও তার নূরানি চেহারার অনুসরন থেকে বিচ্যুতি
দাড়ি শেভ করলে মানুষ রাসুল (সা) এর দেখানো পথ ও তার নূরানি চেহারার অনুসরন
থেকে বিচ্যুত হয়। রাসুল (সা) এর দাড়ি ছিল বড় বড়। [মুসলিম] আমাদের রাসুল (সা) এর অনুসরন করার
ব্যাপারে অনেক বেশি উদ্যমী ও যত্নশীল হতে হবে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ( যার
মানে) :
তোমাদের জন্য মুহাম্মাদ (সা) এর মাঝেই রয়েছে অনুসরনের
জন্য উত্তম সব উদাহরন। [আল আহযাব ৩৩:২১]
এবং রাসুল (সা) ও বলেছেন -
নিশ্চয়ই মুহাম্মাদের দেখানো পথই সবচে উত্তম পথ।
৪। বিশ্বাসীদের পথ থেকে সরে আসা
দাড়ি শেভ
করার ফলে বিশ্বাসীদের চলা পথ থেকেও সরে আসা হয়। সকল নবী – রাসুল,
সাহবী, উলামা ও মুসলিম জাতির প্রথম দিকের সত্যপন্থীরা
দাড়ি রাখত। তাদের কারো ব্যাপারেই ‘দাড়ি শেভ করেছে’
এমন অভিযোগ শোনা যায়নি। সুতরাং তারা ছিলেন অমনই। এজন্যেই আল্লাহ
তায়ালা বলেছেন –
যে
বোঝার পরও রাসুল (সা) এর অবাধ্য হয় এবং বিশ্বাসীদের (সাহাবী) ছাড়া অন্য কারো
অনুসরন করে, সে তাই পাবে যার সে যোগ্য। আর আমরা তাকে পোড়াব দোজখের উত্তপ্ত আগুনে,
থাকার জন্য যা অত্যন্ত খারাপ জায়গা।
৫। অবিশ্বাসীদের অনুকরনঃ
দাড়ি শেভ করার ফলে অবিশ্বাসীদের অনুকরন করা হয়। নবী (সা) এর বিভিন্ন হাদিসে এ বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হয়েছে। উদাহরন স্বরূপঃ
মোচ কেটে ফেল এবং দাড়ি বাড়াও। ম্যাযিয়ানদের (ইরানে প্রচলিত একটি
ধর্মের অনুসারীগন) মত তোমরা নও সেটা দেখাও। [মুসলিম]
মোচ ছেঁটে ফেল আর দাড়ি ছেড়ে দাও। অন্য কিতাবধারীদের চেয়ে আলাদা হও। [মুসলিম]
মোচ ছেঁটে ফেল আর দাড়ি ছেড়ে দাও। অন্য কিতাবধারীদের চেয়ে আলাদা হও। [মুসলিম]
মুশরিকদের (যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত
করে) চেয়ে আলাদা হও। মোচ ছোট কর আর দাড়ি ধরে রাখ। [বুখারী ও মুসলিম]
সুরা ফাতিহাতেও আমাদের উপদেশ দেয়া হয়েছে অবিশ্বাসীদের চেয়ে আলাদা হতে।
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা বলেন (যার মানে)
তাদের মত ফ্যাশন করে চলো না, যাদের ইসলাম
সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। (আল – জারিয়াত ৪৫:১৮)
আর আল্লাহর রাসুল (সা) বলেন –
কোন ব্যাক্তি যাদের অনুসরন করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।
[আবু দাউদ, আল-বানী কর্তৃক হাসান হাদিস হিসেবে স্বীকৃত]
৬। আল্লাহর সৃষ্টিতে অনুমতি ছাড়াই পরিবর্তন আনা
নবী মুহাম্মাদ (সা) বলেন যে, যে নারীরা আল্লাহ তায়ালা তাদের যা
দিয়েছেন তাতে পরিবর্তন আনে (যেমন লোম উঠানো, দাত ঘষে
সুন্দর আকার দেয়া/ভরাট করা অথবা শরীরে উল্কি/ট্যাটু লাগানো) যাতে তাদের সুন্দর
দেখায়, তারা অভিশপ্ত আর এ অভিশাপ আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন।
[বুখারী ও মুসলিম]
হাদিসটিতে বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে বলা হয়েছে কারন সাধারনত তারা ছেলেদের
তুলনায় নিজেদের সুন্দর করার জন্য বেশি উৎসুক থাকে। কিন্তু সতর্কবানীটি অবশ্যই ছেলে
মেয়ে উভয়ের জন্যই, কেননা অভিশপ্ত হবার শর্তগুলোতো বলেই দেয়া হয়েছে তাই এটা
তার জন্যই প্রযোজ্য যে এভাবে নিজেকে সুন্দর করে।
দাড়ি শেভ করাও এই হুঁশিয়ারির আওতাভুক্ত যেহেতু এটা মেয়েদের মুখের লোম
উঠানোর চেয়ে বেশি খারাপ। এতে শয়তানের আনুগত্যই করা হয়। সে বলেছিলঃ
আমি ওদের লোভ দেখাতেই থাকব, যতক্ষণ ওরা আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে বিক্রৃতি না আনবে। [আন-নিসা ৪:১১৯]
আমি ওদের লোভ দেখাতেই থাকব, যতক্ষণ ওরা আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে বিক্রৃতি না আনবে। [আন-নিসা ৪:১১৯]
৭। মেয়েদের মত হওয়া
দাড়ি ছেলে ও মেয়েদের মাঝে লক্ষণীয় পার্থক্য এনে দেয়। শেভ করলে এটা আর থাকে
না। তাই এর মানে হয়, ছেলেগুলোকে মেয়েদের মতই দেখায়। রাসুল (সা) বলেনঃ
আল্লাহ সেই পুরুষদের অভিশাপ দেন যারা মেয়েদের অনুকরন করে এবং তিনি সেই মেয়েদের ও অভিশাপ দেন যারা পুরুষদের অনুকরন করে।
আল্লাহ সেই পুরুষদের অভিশাপ দেন যারা মেয়েদের অনুকরন করে এবং তিনি সেই মেয়েদের ও অভিশাপ দেন যারা পুরুষদের অনুকরন করে।
৮। দাড়ি শেভ করা প্রকৃত বিশ্বাসের পরিপন্থী
রাসুল (সা) পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর প্রকৃতির জন্য মুসলমানের ১০ টি গুনের কথা
উল্লেখ করেন। [মুসলিম] যার ২টি হোল মোচ ছোট করা ও দাড়ি বড় করা।
নবী (সা) আরও বলেন যে প্রত্যেক শিশুই নির্মল ও বিশুদ্ধ
প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহন করে। পরবর্তিতে পরিবেশ, পরিস্থিতির প্রভাবে
তার সে অবস্থা বদলে যায়। [বুখারী ও মুসলিম]
অবিশ্বাসীদের
দেখানো পথে চলে অসংখ্য মুসলিমের মানসিকতা আজ এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছে যে, একটা ক্লিন-শেভড ছেলেকে তাদের কাছে
অনেক বেশি সুশ্রী ও সুপুরুষ মনে হয়। যা রাসুল (সা) উপরের হাদিসে যেভাবে বলেছেন তার
সম্পূর্ণ বিপরীত। ফিতরাহ সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন (যার মানে) –
আল্লাহ
তায়ালার প্রকৃতির উপর নিজেকে দাঁড় করাও, যার উপর তিনি মানুষকে তৈরি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে
কোন রদবদল নেই। [আর-রুম ৩০:৩০]
দাড়ি শেভ
করার জন্য কিছু মানুষ এমন অদ্ভুত অজুহাত দেখায় যে স্ত্রীরা নাকি তাদেরকে সেভাবে
দেখতেই বেশি পছন্দ করে। মনে হয় তাদের জীবনের অর্থই হল বউ এর পচে যাওয়া মনের ইচ্ছে
গুলো পূরণ করা, আল্লাহ ও তার রাসুল (সা) এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও।
অন্যরা দাবি
করে, দাড়ি বড় করলে
তাদের খুব অস্বস্তি হয় ও চুলকায়। এটা আসলে অজু করার সময় সুন্নাহ অনুযায়ী দাড়ি ধুয়ে
পরিষ্কার না করার ফলে হয়।
আলেম ও ইমামগণ যা বলেন
চার ইমাম সহ সকল সালাফী আলেম এ ব্যাপারে একমত যে দাড়ি শেভ করা হারাম। তারা
এ বিকৃতি সাধনের ব্যাপারে কোন ভাবেই অনুমতি দেন না। উমার ইবন আব্দুল আজিজ (র)
সম্পর্কেও এমনটিই বলা হয়েছে। সে সময় কেউ শেভ করলে তাকে মেয়ে মনে করা হত। অনেকেই
তার সাক্ষ্য গ্রহন করত না কিংবা তাকে নামাজ ও পড়াতে দিতনা।
আল্লহা তায়ালা আমাদেরকে তার দেখানো পথে চলার ও রসুলের (সা) সুন্নাহ আঁকড়ে
ধরার তাওফিক দিন এবং উভয় জীবনেই সফলতাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
মূল লেখাঃ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-জিবালি
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত