[যে যখনই আমাকে বলেছে আপনি কেমন আছেন, আমি বলেছি আলহামদুলিল্লাহ আমি ভাল আছি। বাস্তবিকই আমি কখনই খারাপ থাকি না। পৃথিবীর কোন কষ্টই কখনও আমার ভাল থাকার অন্তরায় হয়ে দাড়ায়নি। শুধু একবার ...]
বছর দেড়েক আগের কথা, আমার এক ডাক্তার বন্ধু (ডা: মহসিন) একদিন ফোনে বলে –
‘দাদা বাবা হবার অনুভুতি কেমন জানিস? আমি বাবা হয়েছি।’। বুঝলাম তার সন্তান
হয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানালাম।
আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা ছিলো এবং তার তারিখ ছিলো ১৭ই এপ্রিল (২০০৯)।
সে জানুয়ারী থেকেই তার মায়ের বাড়ী রাজশাহীতে অবস্থান করছিলো। ১৫ই এপ্রিল
আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রাজশাহী যাই এবং হাসপাতালের সাথে কথা হয় ১৬ই এপিল
দুপুরে ভর্তির। ১৬ই এপ্রিল দুপুরে রাজশাহী জমজম হসপিটালে ভর্তি করাই।
ভর্তির পর থেকেই সে বলছিল যে তার একটু একটু ব্যথা হচ্ছে। কর্তব্যরত মহিলা
ডাক্তার স্ত্রীকে পরীক্ষা করে আমাকে জানান তার এখুনি সিজার করতে হবে।
সাথে
সাথে যে ডা: ডটি ম্যাডাম এবং আমার স্ত্রীর ডাক্তার বান্ধবীদের খবর দেয়া
হলো। আমার স্ত্রীকে যখন অপারেশন থিয়েটার এ নেয়া হলো তখন হাসপাতালে শুধু আমি
একা। বাসা থেকে তখনও কেউ এসে পৌছাতে পারে নাই। অপারেশন শুরুর ১০ মিনিটের
মধ্যে থেকে আমার বাবা, শশুর সহ অনেকেই এসে পড়লেন। বিকেল ৫টায় আমি জানতে
পেলাম আমি বাবা হয়েছি। মা এবং সন্তান সুস্থ্য আছে। কিছুক্ষন পরেই মা ও
ছেলেকে কেবিনে দেয়া হলো। কেবিন ভর্তি লোকজন। সবাইকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন
করা হলো। রাতে আমার স্ত্রীর-সন্তানের সাথে কেবিনে থেকে গেলাম। তখন
রাজশাহীতে প্রচন্ড গরম। সারারাত জেগে দুজনকে পাহারা দিলাম। পরেরদিন দুপুরে
একটা সমস্যা দেখা দিলো- ছেলে পায়খানা করছে না। আমরা যে হাসপাতালে ছিলাম
সেখানে শিশু বিভাগ না থাকায় ছেলেকে সেদিন রাতে রাজশাহী মেডকেল কলেজ
হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো এবং সে রাতেই সে পায়খানা করে। পরেরদিন তাকে
বাড়ীতে(ছেলের নানুর বাসায়) নিয়ে আসা হলো। তার দুইদিন পরে আমি ঢাকায় চলি
আসি।
পুর্বেই বলেছি তখন রাজশাহীতে প্রচন্ড গরম এবং প্রচন্ড মশা। একেকটি মশা
মাছির সমান এবং যেখানে হুল ফোটায় সেখানে জ্বলতে থাকে। রাতে কয়েকবার বিদ্যুত
চলে যায়। দুর্বিসহ জীবন। ঢাকায় তখন বিদ্যুত গেলেও রাজশাহীর মতো নয় এবং
ঢাকায় আমি যে বাসায় থাকি সেটা বেশ ঠান্ডা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তাদেরকে
ঢাকায় নিয়ে চলে আসবো। সেই মোতাবেক ৩০শে এপ্রিল রাজশাহী যাই। গিয়ে দেখি
ছেলেকে যেখানে যেখানে মশা কামড়েছে সেখানে সেখানে বড় ফোড়ার মতো হয়ে গিয়েছে।
যদিও মশারী ছিলো কিন্তু তাতেও রেহাই হয় নাই। ১লা মে ছেলেকে আমাদের
বাড়ীতে(ছেলের দাদা বাড়ী) নিয়ে যাই সেখানে তার আকিকা দেয়া হয় এবং নাম রাখা
হয় “লাবিব হাসান”। ২রা মে আমরা আবার রাজশাহীতে চলে আসি। ৪ঠা মে সিল্কসিটিতে
করে ঢাকা আসি। ছেলের যেন কষ্ট না হয় এই জন্য ট্রেনে ৪ সিটের একটি কামরা
ভাড়া করে নিয়েছিলাম।
৬ই মে আমার স্ত্রী জানালো ছেলে একটু একটু পাতলা পায়খানা করছে। আমি শেওড়া
পাড়ায় থাকতাম। সেখানে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা: ইমনুল ইসলাম ইমন স্যার বসতেন।
আমার স্ত্রী মিরপুর-১০ এ গ্যালাক্সী হসপিটালে কর্মসুত্রে ইমন স্যারের সাথা
পরিচিত। তাই তাকে দেখানো হলো। তিনি জানালেন ভয়ের কিছু নাই ছোট বাচ্চারা
অনেক সময়ই এমন পায়খানা করে। ১১ তারিখে পায়খানার পরিমান অনেক বেড়ে গেল। আমরা
আবার স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন বাচ্চার অনেক পানি লস হয়েছে, কাজেই
একটি স্যালাইন দিলেই আসা করা যায় সব ঠিক হবে। সেইদিনই আমরা মিরপুর-১০ এ
গ্যালাক্সি হসপিটাল এ ভর্তি হলাম। সেখানে ৪দিন থাকতে হলো। পায়খানা কমে আসায়
স্যার বললেন ইনশাআল্লাহ ভালো হয়ে যাবে। এখন বাসায় যেতে পারেন। আমরা ১৫ই মে
বাসাতে চলে আসলাম। ১৬ই মে বিকেলে তার অবস্থা আবার খারাপ হতে লাগলো এবং
বিকেলের মধ্যে শুধু পানি বের হতে শুরু করলো, এবং সন্তান নিস্তেজ হয়ে গেল।
আমরা ইমন স্যারের কাছে গেলে তিনি ডা: এম আর খান এর কাছে যেতে বললেন। আমরা
জানতে পেলাম উনি নাকি মিরপুর-২ এর শিশু হসপিটাল এবং ধানমন্ডিতে বসেন।
মিরপুর-২ বাড়ীর কাছে হওয়াতে আমরা সেখানেই ভর্তি হলাম। সেখানে ডা: ফজলুল হক
নাজির এর তত্বাবধানে ছিলাম। সেখানে তিনি প্রতিদিন দুপুরে আসতেন একটি করে
টেষ্ট ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতেন। প্রতিটি টেষ্ট করাতে হতো আইসিডিডিআর,বি থেকে।
এভাবে ৪ দিন নষ্ট হলো কোনো চিকিতসা ছাড়া। আর এই চারদিন ননস্টপ স্যালাইন
চলেছে। আমরা হতাশ হয়ে ২০ই মে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হলাম। চারতলার
কেবিনে ছিলাম। ভর্তি ছিলাম ডা: ফরিদ স্যারের আন্ডারে। কিন্তু তিনি ঐ
মুহুর্তে দেশে না থাকায় ডা: জাহাঙ্গীর আমার বাচ্চাকে দেখতেন। এখানে এসেও
প্রতিদিন অসংখ্য টেস্ট এর সম্মুখিন হলাম। আমার স্ত্রীর পরিচিত এক ভাবী ডা:
তামান্না সেখানে কর্মরত থাকায় এবং তার আপ্রান সহযোগিতা আমাদের অনেক কষ্টই
কমে গিয়েছিল। বাচ্চার “বেড ডক্টর” ডা: শারমিন এবং রেজিষ্টার ডা: সাগরের
সহযোগিতা আমাদের সারা জীবন মনে থাকবে।
ডা: শারমিন একদিন একদিন ডা: আজাদ স্যারকে ধরে নিয়ে আসলেন। এরপর থেকে
মুলতই ডা: আজাদ স্যারই বাচ্চাকে দেখতেন। চতুর্থতলার সংস্কার কাজের জন্য
কেবিন ছেড়ে আমাদের ছয়তলার ৯নং কেবিনে চলে যেতে হয়। ডা: আজাদ আমাদেরকে একটি
দুধ সংগ্রহ করতে বলেন। প্রেজিষ্টিমিল অথবা প্রসবি। ঢাকার কোথাও এ দুধ পেলাম
না। এরই মধ্যে হঠাত একদিন ডায়রিয়ার পাশপাশি বাচ্চা কালো পায়খানা করলো। এটা
দেখে আমার স্ত্রী কেদে বললো বাচ্চা বাচবে না। যে পায়খানা হলো এটাকে নাকি
মেলিনা বলে এবং মেলিনার রোগী নাকি সাধারনতই বাচে না। আমি ভয় পাই, কিন্তু
আশা ছাড়িনা। আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। মেলিনা শুরু হবার সাথে সাথে আজাদ
স্যার বাচ্চার এনপিও(নাথিং পার ওরাল) অর্থাত মুখে খাবার বন্ধ করে দিলেন।
শুধু স্যালাইন এবং এর মাধ্যমে ভিটামিন এবং অন্যান্য দরকারী ভিটামিন দেয়া
হতে লাগলো। ডা: আজাদ স্যার আরকেটি দুধ সংগ্রহের জন্য বললেন। দুধটির নাম –
নিউট্রামিজেন। এটিও ঢাকার কোথাও পেলাম না। মনের দু:খে আমেরিকাতে বসবাসরত
কবির ভাইকে অনুরোধ করলাম দুধগুলোর যেকোন একটি সংগ্রহ করে দিতে। দিতে তার শত
ব্যস্তার মাঝেও ৩টিন দুধ কুরিয়ার করে দিলেন।
এর মধ্যে প্রতি মুহুতেই স্যালাইন চলছে। অতটুকু মাসুম বাচ্চার শরীরে
সমানে সুই ফুটিয়ে চলেছি চিকিতসার নামে। প্রতিনিয়তই টেষ্ট চলছে। পায়খানা,
পেশাব, রক্ত। কেন টেষ্টই কোন অসুখ খুজে পাওয়া যায় না।
দুধ আসার পরে, বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো শুরু করা হলো। এর মধ্যে সে মোট ৫
দিন খাবার ছাড়া ছিলো। এই পাচদিনে তার কালো পায়খানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কি
যে বিভতস সময় গেছে। বাচ্চা সারা রাত খাবার জন্য কাদে। আমরা খাবার দিতে
পারিনা। বাবা-মা বসে বসে কাদি আর সন্তানের কান্না দেখি। দুধ খাওয়ানের ২ দিন
পর থেকে আল্লাহর রহমতে তার আবার পায়খানা স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। এভাবে
৫দিন পর সব স্বাভাবিক হলে ২০ই জুন আমরা হাসপাতাল থেকে বাসায় যাই।
বাসাতে প্রথম কয়দিন ভালোই ছিলাম। ২৬শে জুন থেকে আবার একটু একটু করে
পায়খানা শুরু হলো। ২৭শে জুন অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যেতে লাগলো। ২৭শে জুন
সন্ধ্যায় আবার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হলাম। ২ দিন পরে আবার মেলিনা শুরু
হলো। ২রা জুলাই অবস্থা খুবই অবনতি হলো, তার নিশ্বাস এবং হার্ট প্রায় বন্ধ
হয়ে গেল। তাকে আইসিইউ তে নেয়া হলো। সম্ভবত ৪ই জুন তাকে কৃত্রিম শ্বাস দিয়ে
রাখা হয় এবং পরবর্তি ৩০ ঘন্টা এভাবে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে সে রিকোভার
করতে থাকে। ১১ই জুলাই তাকে আইসিইউ থেকে আবার কেবিনে নেয়া হয় এবং ১৮ই জুলাই
তাকে বাসায় নেয়া হয়। এরই মধ্যে আমার সন্তানের শরীর বলতে কিছু নেই। প্রতিটি
শিরাতে স্যালাইনের সুই এর দাগ। শুধু কংকালের উপর চামড়ার প্রলেপ। সেই কংকাল
বুকে নিয়েই আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ এর জীবনটুকু ভিক্ষা দাও।
২৪শে জুলাই আবার ডায়রিয়া শুরু হয় এবং ২৫শে জুলাই সে বমি শুরু করে। রাত
দুইটার সময় তাকে কলেরা হাসপাতালে (আইসিডিডিআর, বি) ভর্তি করি। সেখানের
কর্তবত্যরত ডাক্তার তাকে জরুরী ভিত্তিতে আইসিইউতে ভর্তি করান। সেখানে তাকে
রাখা হয় এবং নাকে নলের সাহায্যে কাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে একটি
টেষ্টে প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে যে তার হাইপো-থাইরয়েড হয়েছে। সেই অনুযায়ী
চিকিতসাও চলে ডায়রিয়ার পাশাপাশি। ১লা আগষ্ট মাঝরাতে আমার স্ত্রী কাদতে
কাদতে ফোন দিলো বাচ্চার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, কয়েকদিন থাকা নাকের নলের কারনে
তার নাকের ভেতরে হয়তো কেটে দিয়েছে। আমি বললাম তার না খুলে ফেলো যদি তাকে
মুখে খাওয়ানো যায়। তার নাকের নল খুলে মুখে খাওয়ানো শুরু হলো। ডায়রিয়া কমে
এলো কিন্তু নাক আস্তে আস্তে লাল হতে লাগলো।
সম্ভবত ৪ই জুলাই আমরা কলেরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই। আইসিইউ এর কয়েকজন
নার্স যারা এক সময় স্কয়ার হসপিটালে ছিলেন তারা বললেন যদি সম্ভব হয় তবে
বাচ্চাকে যেন ডা: জাবরুল স্যারকে একটু দেখাই। আমরা সোজা স্কয়ারে চলে গেলাম।
সেখানে জাবরুল স্যার বাচ্চাকে দেখে খুবই ভয় পেলেন বললেন বাচ্চার যে
এরিয়াতে ইনফেকশ এখান থেকে ব্রেইনএ ইনফেকশন হতে সময় লাগবে না। তিনি বললেন
যদি আমরা তাকে অন্তত ৫ দিন সময় দেই তাহলে তিনি এই ইনফেকশনটি থামানোর চেষ্টা
করবেন। পকেটে তখন মাত্র ২০০০ টাকা। বাসায় কোনো টাকা নেই। ইতমধ্যেই কয়েক
লক্ষ টাকা শেষ হয়েছে। আমি তিন তলার সিড়ির কাছে এসে কাদছি। কি করবো কেথায়
যাবো কার কাছে টাকা চাইবো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাচ্চার বড় খালা আমাদের
সাথেই ছিলেন। তিনি এসে বললেন ভাইয়া একটু ধৈর্য্য ধরেন ইনশাআল্লাহ সব
ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এর পরে সবাই সবার ব্যাগ খুজে পেতে যা পেলাম সব জমা
করলাম। হঠাত মনে হলো আমার ডাচ-বাংলা ব্যাংকে কিছু টাকা থাকতে পারে। দৌড়ে
বুথে গিয়ে পেলাম ৭০০০ টাকার মতো। সব মিলিয়ে ১০০০০ টাকা নিয়ে ভর্তি হলাম
স্কয়ারে। এরই মধ্যে বাচ্চার নাকের চারপাশ ফুলে লাল হয়ে গেছে, কিছু কিছু
জায়গায় পুজ জমে গেছে কিছু জায়গা কালচে রং হয়ে গেছে। সেখানে ব্লাড কালচার
করতে দেয়া হলো। এবং ৬ তারিখে রিপোর্টে তার রক্তে ইনফেকশ পাওয়া গেল। ডাক্তার
জানালেন তাদের কাছে এই ইনফেকশনের ঔষধ আছে এবং দিলে ইনশাআল্লাহ ভালো হয়ে
যাবে।
৭ই আগষ্ট শুক্রবার সকালে আমার স্ত্রী হঠাত দেখতে পেল বাচচার ডান পাশের
বুক অনেক বসে গেছে। এক্সরে করে পাওয়া গেল তার ডান ফুসফুস অকেজো হয়ে গেছে।
এই প্রথম আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম আমার সন্তান আর বাচবে না। এতোদিন
এক মুহুর্তের জন্যও আমি আশা ছাড়িনি। কিন্তু তার শ্বাস নেবার কষ্ট দেখে আমি
নিজেই আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম আল্লাহ তার মৃত্যু আমি মেনে নিবো কিন্তু
তুমি আমাকে আমার বাচ্চার এই কষ্ট আর দেখিও না।
আমার স্ত্রীর কপালে ঘুম নেই সন্তান হবার পর থেকেই। স্কয়ারে আসার পরেতো
আরও নেই। সেদিন সে কেবিনে সোফাতে ঘুমিয়েছে। আমি ছেলের পাশে শুয়ে আছি। একটু
পর পর উঠে দেখি পায়খানা পেশাব করছে কিনা। এমনিতেই নাকের ইনফেকশনের কারনে
তার নাকের ফুটো এতো সরু হয়ে গিয়েছিলো যে তার নিশ্বাষ নিতে খুবই কষ্ট
হচ্ছিলো। মাঝরাতে একবার গায়ে হাত দিয়ে দেখি ছেলে গা ঠান্ডা হয়ে আছে। যদিও
সে কম্বলের মধ্যেই থাকতো। রুম হিটার দিয়ে তা গা গরম করে, কম্বলগুলো গরম করে
আবার তাকে ঢেকে দিলাম। ভোর ছয়টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আমার বেডের
চারিদেক ডাক্তার এবং নার্সে ভরা। তাড়াতাড়ি উঠে দেখি ছেলে শ্বাস নিচ্ছে
অনিয়মিত। একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী ডেকে তুলে আমি ফজরের নামাজ
পড়লাম। স্ত্রী বাচ্চার চোখে দেখে জানালো সেই নির্মম সত্যের কথা। বাচ্চা
মারা গেছে।
এই প্রথম বুঝলাম আমি কি হারালাম। এই প্রথম বুঝলাম কষ্ট কাকে বলে।
সকাল নয়টায় একটা ভাড়া করা মাইক্রোতে করে দেশের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা
দিলাম। ২ টার দিকে আমাদের বাড়ী পৌছলাম। যে বাড়িতে ৪ মাস আগে ছেলেকএ বুকে
নিয়ে ঢুকেছিলাম হাসি মুখে। বাবা-মায়ের হাতে তুলি দিয়েছলাম তাদের বংশের
প্রদীপকে। সেই বাড়িতেই মৃত সন্তানের লাশ কোলে করে ঢুকলাম। তুলে দিলাম আমার
মায়ের হাতে।
কতজনের মুখেই শুনেছি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বোঝা হলো পিতার কাধে সন্তানের লাশ। এখন বুঝি সেটা কতটাই ভারী …
শেষ কথাঃ আমি জানিনা এই বাবাটি কে! তবে আমি জানি এরকম এক একজন বাবা
আমাদের ঘরেও আছে। বছর দুই এক আগের কথা। আমার বড় ভাই পায়ে এক্সিডেন্ট করল।
খুবই ভয়াবহ এক্সিডেন্ট। উনি আবার হাঁটতে পারবেন সেটা আমরা কেউ মনে করিনি।
আমাদের পরিবার যার আয়ের উপর চলে তার এই ভয়ানক দুর্ঘটনায় আমাদের মানসিক
অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে দিনের পর দিন চিকিৎসা চলে। অপারেশন হল দুইবার।
এরপর পায়ে প্রতিদিন ড্রেসিং চলে। যখনি আমার ভাইকে অপারেশন থিয়েটারে নিত
আমি দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এই অপারেশন থিয়েটারের সামনে এই কয়েকমাসে
আল্লাহ আমাকে কিছু মর্মস্পর্শী এবং কিছু অসাধারণ দৃশ্য দেখার সুযোগ
দিয়েছিলেন। গ্রাম থেকে এক সন্তানসম্ভবা মাকে নিয়ে আসা হয়েছে। সাথে
অনেকেই____ স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, পাড়ার মুরব্বি গোত্রীয় অনেকেই। আমার
ভাইকে প্রতিদিন এনাস্থেশিয়া দিত না। যেদিন দিতনা সেদিন তীব্র যন্ত্রনায় সে
চিৎকার করত আর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমি সেটা শুনতে পেতাম। ঐদিনও চিৎকার
শুনছি আর দেখছি আমার সামনে এক বাবার ছুটাছুটি। কিছুক্ষণ নার্সের কাছে যায়,
কিছুক্ষণ সাথের মুরব্বিদের সাথে কথা বলে, কিছুক্ষণ বারান্দার এ প্রান্ত
থেকে ও প্রান্ত হাঁটাহাঁটি। টেনশনে চেহারা শুকিয়ে গেছে। যে যার মত আলাপ
করছে, ছেলে হবে না মেয়ে হবে এসব নিয়ে কথা বলছে আর আমি এক দৃষ্টিতে ওই বাবার
দিকে চেয়ে আছি। এরকম দৃশ্য আমার জীবনে এই প্রথম। এতো টেনশন একজন বাবার তার
সন্তানের জন্য যে কিনা এখনো জন্মই নেয়নি!! অনেকক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটারের
দরোজা খুলল। ওই বাবা ছুটে গেল কিন্তু না…… তার জন্য কোন সংবাদ নেই!! আমার
ভাইকে বের করা হয়েছে। ওয়ার্ডবয়রা আমার ভাইকে রুমে নিয়ে গেল তারপরও আমি
অপারেশন থিয়েটারের সামনে রয়ে গেলাম। ওই বাবার টেনশনে আমারও খুব জানতে ইচ্ছে
হচ্ছিল ছেলে হয় না মেয়ে! অপেক্ষা করতে করতে একসময় দরোজা আবার খুলল। নার্স
সন্তান জন্ম আর বাচ্চা- মা উভয়ের সুস্থতার সংবাদ জানিয়ে দিলেন। সবাই
ছুটাছুটি, মোবাইলে খবর জানাতে লাগলো। এই হৈ চৈ এর মধ্যে আমি অবাক হয়ে
দেখলাম এতক্ষন ধরে একাই চারদিক ছুটাছুটি করা এই বাবা কোলাহলের মধ্যে মুখটা
আড়াল করে কিছু একটা লুকালেন। আর কেউ না দেখুক আমি দেখলাম তিনি তার চোখের
পানি মুছলেন। সুবাহানাল্লাহ। কি অসাধারণ একটা দৃশ্য। এই দৃশ্যটা আমার
প্রায়ই মনে পড়ে আর সুযোগ পেলেই এই ঘটনাটা আমি সবাইকে বলি। সুবাহানাল্লাহ।
সেই কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে_____ পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে কিন্তু
একটিও খারাপ বাবা নেই!!