২৫শে
ডিসেম্বর, ২০০৪ এর কথা । ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কিছু ইমাম জানতে
পারলেন এলাকার একদল মুসলিম এলাকায় আগত খৃষ্টান টুরিস্টদের সাথে বড়দিনের
উৎসব করার পরিকল্পনা করছে । ইমামরা বুঝতে পারলেন এলাকার দায়িত্বশীল হিসেবে
এই লোকগুলোকে সাবধান করার তাদেরই দায়িত্ব । মুসলিমদের এ উৎসব পালন করার
অনুমতি নেই, বরং তা খুবই বড় এক পাপাচার যা একজনকে ইসলাম থেকে খারিজ করে
দিতে পারে । আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেনঃ
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
"কেউ যাদেরকে অনুসরণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত (হিসেবেই গণ্য হবে) ।
যেই রেঁস্তোরায় মুসলিমরা বড়দিনের উৎসবে অংশ নিচ্ছে বলে খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, ইমামরা সেখানে পৌছালেন এবং দেখলেন কিছু মুসলিম খৃষ্টানদের সাথে মদ পান করছে এবং বড়দিনের গান গাচ্ছে । ইমামদের জানা ছিল যে এই মুসলিমগুলো শুধুমাত্র রাত্রে কিছু পয়সা কামাই করার জন্যই এই কাজ করছে, কিন্তু এটা কোন ওজর হতে পারে না । অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে কোন কারনেই অংশগ্রহন করা আমাদের মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত নয় । তারা একজন যুবককে উপদেশ দেয়ার জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলেন । কিন্তু হঠাৎ করেই সেই যুবক উঠে দাঁড়াল । মাতাল সেই যুবক ইমামদেরকে মারধর শুরু করল । ঘটনার আকস্মিকতায় ইমামরা হতভম্ব হয়ে সে স্থান ত্যাগ করলেন । মসজিদে গিয়ে দু'আ করলেন পথভ্রষ্ট লোকগুলোর জন্য ।
পরদিন ভোরে ফজরের আজান দেয়া হলে প্রকৃত মু'মিন ব্যক্তিরা উঠলেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে, তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে, এবং তার শুকরিয়া আদায় করতে । আর যারা সেদিন ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন, তাদের আর কোন দিন নামাজ পড়ার সুযোগ পেল না । জোহরের পূর্বেই তারা সবাই মারা গেলেন।
ফজরের নামাজের কয়েক ঘন্টা পরেই আল্লাহর গজব নেমে এল । ভয়ংকর উন্মত্ততায় মাটি কেঁপে উঠল, যার প্রচণ্ডতা ১,৫০০ পারমাণবিক বোমাকেও হার মানায় । সমুদ্রতলদেশের মাটি কেঁপে উঠল, ফলে প্রকাণ্ড আকৃতির ঢেঊ সৃষ্টি হল যা স্থলভাগের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এল । কোন রকম সাবধানবাণীর সুযোগ ছাড়াই, কাউকে পালানোর কোন উপায় না রেখেই সুনামি আঘাত করল । অনেকেই ছিল যারা নিজেদের বিছানায় ঘুমাচ্ছিল, কি ঘটছিল তা তাদের বোঝার উপায় ছিলনা । কেউ ছিল সমুদ্র সৈকতে, বিশাল আকৃতির ঢেউগুলোর দিকে আতংকগ্রস্থ চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কিছু করার ছিল না । আরও ছিল কিছু মানুষ, যারা আগের রাত্রের মদ্যপানজনিত মাথাব্যাথা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল । ভয়ংকর আক্রোশে স্রোত আঘাত হানল; তার পথে যেটাই আসল, প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করে, উজাড় করে এগিয়ে গেল । গ্রামের পর গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে গেল, তাদের জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন । কেউ জানত না মৃত্যু এই সময় এইভাবে চলে আসবে । কিন্তু আল্লাহ চাইলেন, আর তা হয়ে গেল । আর প্রত্যেকেই যে অবস্থার উপর মৃত্যুবরণ করল সেভাবেই সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য চলে গেল । কেউ তো তাঁর আনুগত্যে মৃত্যুবরণ করল, আর কেউ গেল পাপাচারে লিপ্ত, মুনাফিকি ও কুফরের উপর।
সেই রাত্রে আগের রাত্রের কিছু ইমাম 'ঈশার সলাতের জন্য এক হলেন । তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, যারা ফজরের সলাতে হাজির ছিলেন, তাদের সবাই 'ঈশার জন্য এসেছেন । এবং এই মসজিদটি আশপাশের দালানগুলোর ন্যায় ধ্বংস হয়নি, বরং তাতে কিছু আঁচড় পড়েছে কিনা সন্দেহ । ধ্বংসলীলার সময় যারা মসজিদের ভিতরে ছিল তাদের কাছ থেকে জানা যায়, তারা স্রোত আসতে দেখেছিল, কিন্তু সেগুলো মসজিদের ডানদিক-বাঁ দিক দিয়ে পার হয়ে চলে যাচ্ছিল । মসজিদের বা ভিতরে থাকা লোকজন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি । এটা আচেহ প্রদেশের শুধু একটা মসজিদের ঘটনা নয়, বরং পুরো প্রদেশ জুড়েই এমন অনেক মসজিদের কথা জানা যায় ।
ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট স্রোত এতই শক্তিশালী ছিল যে তা শুধু ইন্দোনেশিয়া নয়, বরং ভারত ও মালদ্বীপ পর্যন্ত পৌছে যায়, এমনকি ভারত সাগর পার হয়ে সোমালিয়ার উপকুলে আঘাত হানে । সর্বমোট ২,৮০,০০০ মানুষ মারা যায় । এর মধ্যে ১,৬০,০০০ ছিল ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলিম লোকসংখ্যার দেশে, এবং তাও আচেহ প্রদেশে, যেখানে কিনা মুসলিমদের শতকরা হার ছিল সবচেয়ে বেশি । সুনামির আঘাত হানার সময়কাল এবং মুসলিমদের চারিত্রিক অধঃপতনের মধ্যে সম্পর্ক অনেকের চোখেই ধরা পড়েছিল । এটা ছিল আল্লাহর একটি আয়াত (নিদর্শন) মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য । এটা ছিল বিশ্বজগতের রব্ব-এর পক্ষ থেকে এক সতর্কবাণী । তার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, যা মানবসৃষ্ট নোংরামি ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে গিয়েছিল । আর মানুষেরা তাদের রব্বের এই সতর্কবাণী গ্রহন করেছিল, Tsunami শব্দটাকে তারা নিজেদের কাছে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিল তা থেকে এটা বোঝা যায় - "TSUNAMI - Tuhan Suruh Ummat NAbi Muhammad Insaf" - যার অর্থ দাঁড়ায় - "আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদিকে তওবার আদেশ/আহ্বান করেছেন ।"
নিঃসন্দেহে এই ঘটনা আমাদের জীবৎকালের মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূর্যোগ । শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে এখানে । সময় এসেছে নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করার, আমরা কি সারা রাত কাফিরদের মন মাতাতে বড়দিনের গান গাইতে ব্যস্ত লোকগুলোর মত হতে চাই, যারা এভাবেই মারা গেলো এবং তাদের প্রভুর সাথে এভাবেই দেখা করবে, শিরক ও কুফরে লিপ্ত অবস্থায় ? ওখানে আপনিও থাকতে পারতেন, আজাব আপনার জনপদের উপরেও আসতে পারত । কিন্তু আল্লাহ আপনাকে সুযোগ দিয়েছেন চিন্তা করার, শিক্ষা নেওয়ার, তওবা করার । মৃত্যুর পরে তওবার কোন সুযোগ নেই । নেই ভুল পথে হেটে পাপাচারে লিপ্ত থাকার বিলাসীতার সুযোগ । সময় এসেছে আমার ও আপনার প্রভুর একনিষ্ঠ দাসত্ব করার, প্রকৃত মু'মিন হওয়ার, যার অন্তর শুধু আল্লাহর স্মরণেই প্রশস্ত্বি লাভ করে ।
সুনামির পর অস্ট্রেলিয়ান এক ইমাম ত্রানকার্জে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশিয়া যান । আচেহ প্রদেশের লক্সেউমাবে শহরে পৌছে ধ্বংসস্তুপের মাঝে হাটার সময় তিনি একটি বই খুঁজে পান, তার মনে হয় বইটির কভারে কিছু লেখা আছে । তিনি বইটি পড়তে গিয়ে যা খুঁজে পেলেন তা তাঁকে বিস্মিত করে । বইটি এক তরুণী মুসলিমাহ্ বোনের ছিল । তিনি এই বইটিকে একই সাথে নিজের ডায়েরি লেখার জন্য এবং কুরআন ও হাদীসের আয়াত লিখার জন্য ব্যবহার করতেন । বইটি শুরু হয়েছিল "বিসমিল্লাহির রহ্মানির রহীম" এবং কিছু কুরআনের আয়াত দিয়ে যা বোনটি সেই সময় হিফয্ করছিলেন । এছাড়া আরও ছিল কিছু হাদীস এবং তার ইসলামিক ক্লাসের কিছু নোট । এ ডায়েরীতে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ ঘটনাই তিনি লিখে রেখেছিলেন । বিভিন্ন রঙ ও নকশায় ডায়েরিটি অলংকৃত ছিল । সন্দেহ নেই বইটি ছিল তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বইয়ের শেষে লেখা ছিল, "I Love Islam" - আর একটি দু'আ যা সে আল্লাহর কাছে করেছিল - " আমি শাহাদাতের মৃত্যুর আশা রাখি ।"
ইমাম আশেপাশে মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, সে সুনামিতে মৃত্যুবরণ করেছে ।
আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেনঃ
وَالْغَرِقُ شَهِيدٌ
"যে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ ।"
আল্লাহর কাছে আমার দু'আ যে বোনটির দু'আ তিনি কবুল করুন, আর তাকে জান্নাতে দাখিল করুন । হতে পারে সে পৃথিবীর দরিদ্র একটি অঞ্চলের অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু আমার এবং আরও অনেকের অন্তর ছুঁয়ে গেছে তার ঘটনা । আল্লাহর প্রতি তার ভালবাসা, একজন মুসলিমাহ্ হতে পেরে তার গর্ব, তাওহীদের উপর অটল থেকে তার জীবন ও মৃত্যু এবং শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে তার আবেদন, এ সব কিছুই । তার জীবনে তার পক্ষে এটা জানা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না, কিন্তু একজন প্রকৃত মু'মিন হিসেবে সে আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই একটি প্রেরণা । আমাদের জন্য একটিই প্রশ্ন, যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন অবকাশ নেইঃ
আমরা কার মত হতে চাই ? আল্লাহর অবাধ্যতায় নিমজ্জিত থেকে, তার হারাম করা মদ পান করে, এবং কাফিরদের সাথে মিলে মিশে তাদের মত বস্তুবাদী জীবন-যাপন করতে চাই ? নাকি সেই খালেস বিশ্বাসীর মত, যে তার প্রভুর হক্ক আদায় করেছে, তাঁর উপর সন্তুষ্ট এবং ইসলামকে নিজের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট, এবং তার প্রভুর কাছে ঈমান নিয়ে সাক্ষাত করে ?
হে মুসলিম ! সিদ্ধান্ত তো তোমার হাতেই । যদি এখনও তওবা না করে থাক, আর দেরি করো না । তুমি তো জানো না তোমার জীবনে "আগামীকাল" আদৌ আসবে কিনা !
লিখেছেনঃ Brother Musa Cerantonio
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
"কেউ যাদেরকে অনুসরণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত (হিসেবেই গণ্য হবে) ।
যেই রেঁস্তোরায় মুসলিমরা বড়দিনের উৎসবে অংশ নিচ্ছে বলে খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, ইমামরা সেখানে পৌছালেন এবং দেখলেন কিছু মুসলিম খৃষ্টানদের সাথে মদ পান করছে এবং বড়দিনের গান গাচ্ছে । ইমামদের জানা ছিল যে এই মুসলিমগুলো শুধুমাত্র রাত্রে কিছু পয়সা কামাই করার জন্যই এই কাজ করছে, কিন্তু এটা কোন ওজর হতে পারে না । অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে কোন কারনেই অংশগ্রহন করা আমাদের মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত নয় । তারা একজন যুবককে উপদেশ দেয়ার জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলেন । কিন্তু হঠাৎ করেই সেই যুবক উঠে দাঁড়াল । মাতাল সেই যুবক ইমামদেরকে মারধর শুরু করল । ঘটনার আকস্মিকতায় ইমামরা হতভম্ব হয়ে সে স্থান ত্যাগ করলেন । মসজিদে গিয়ে দু'আ করলেন পথভ্রষ্ট লোকগুলোর জন্য ।
পরদিন ভোরে ফজরের আজান দেয়া হলে প্রকৃত মু'মিন ব্যক্তিরা উঠলেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে, তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে, এবং তার শুকরিয়া আদায় করতে । আর যারা সেদিন ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন, তাদের আর কোন দিন নামাজ পড়ার সুযোগ পেল না । জোহরের পূর্বেই তারা সবাই মারা গেলেন।
ফজরের নামাজের কয়েক ঘন্টা পরেই আল্লাহর গজব নেমে এল । ভয়ংকর উন্মত্ততায় মাটি কেঁপে উঠল, যার প্রচণ্ডতা ১,৫০০ পারমাণবিক বোমাকেও হার মানায় । সমুদ্রতলদেশের মাটি কেঁপে উঠল, ফলে প্রকাণ্ড আকৃতির ঢেঊ সৃষ্টি হল যা স্থলভাগের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এল । কোন রকম সাবধানবাণীর সুযোগ ছাড়াই, কাউকে পালানোর কোন উপায় না রেখেই সুনামি আঘাত করল । অনেকেই ছিল যারা নিজেদের বিছানায় ঘুমাচ্ছিল, কি ঘটছিল তা তাদের বোঝার উপায় ছিলনা । কেউ ছিল সমুদ্র সৈকতে, বিশাল আকৃতির ঢেউগুলোর দিকে আতংকগ্রস্থ চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কিছু করার ছিল না । আরও ছিল কিছু মানুষ, যারা আগের রাত্রের মদ্যপানজনিত মাথাব্যাথা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল । ভয়ংকর আক্রোশে স্রোত আঘাত হানল; তার পথে যেটাই আসল, প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করে, উজাড় করে এগিয়ে গেল । গ্রামের পর গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে গেল, তাদের জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন । কেউ জানত না মৃত্যু এই সময় এইভাবে চলে আসবে । কিন্তু আল্লাহ চাইলেন, আর তা হয়ে গেল । আর প্রত্যেকেই যে অবস্থার উপর মৃত্যুবরণ করল সেভাবেই সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য চলে গেল । কেউ তো তাঁর আনুগত্যে মৃত্যুবরণ করল, আর কেউ গেল পাপাচারে লিপ্ত, মুনাফিকি ও কুফরের উপর।
সেই রাত্রে আগের রাত্রের কিছু ইমাম 'ঈশার সলাতের জন্য এক হলেন । তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, যারা ফজরের সলাতে হাজির ছিলেন, তাদের সবাই 'ঈশার জন্য এসেছেন । এবং এই মসজিদটি আশপাশের দালানগুলোর ন্যায় ধ্বংস হয়নি, বরং তাতে কিছু আঁচড় পড়েছে কিনা সন্দেহ । ধ্বংসলীলার সময় যারা মসজিদের ভিতরে ছিল তাদের কাছ থেকে জানা যায়, তারা স্রোত আসতে দেখেছিল, কিন্তু সেগুলো মসজিদের ডানদিক-বাঁ দিক দিয়ে পার হয়ে চলে যাচ্ছিল । মসজিদের বা ভিতরে থাকা লোকজন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি । এটা আচেহ প্রদেশের শুধু একটা মসজিদের ঘটনা নয়, বরং পুরো প্রদেশ জুড়েই এমন অনেক মসজিদের কথা জানা যায় ।
ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট স্রোত এতই শক্তিশালী ছিল যে তা শুধু ইন্দোনেশিয়া নয়, বরং ভারত ও মালদ্বীপ পর্যন্ত পৌছে যায়, এমনকি ভারত সাগর পার হয়ে সোমালিয়ার উপকুলে আঘাত হানে । সর্বমোট ২,৮০,০০০ মানুষ মারা যায় । এর মধ্যে ১,৬০,০০০ ছিল ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলিম লোকসংখ্যার দেশে, এবং তাও আচেহ প্রদেশে, যেখানে কিনা মুসলিমদের শতকরা হার ছিল সবচেয়ে বেশি । সুনামির আঘাত হানার সময়কাল এবং মুসলিমদের চারিত্রিক অধঃপতনের মধ্যে সম্পর্ক অনেকের চোখেই ধরা পড়েছিল । এটা ছিল আল্লাহর একটি আয়াত (নিদর্শন) মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য । এটা ছিল বিশ্বজগতের রব্ব-এর পক্ষ থেকে এক সতর্কবাণী । তার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, যা মানবসৃষ্ট নোংরামি ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে গিয়েছিল । আর মানুষেরা তাদের রব্বের এই সতর্কবাণী গ্রহন করেছিল, Tsunami শব্দটাকে তারা নিজেদের কাছে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিল তা থেকে এটা বোঝা যায় - "TSUNAMI - Tuhan Suruh Ummat NAbi Muhammad Insaf" - যার অর্থ দাঁড়ায় - "আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদিকে তওবার আদেশ/আহ্বান করেছেন ।"
নিঃসন্দেহে এই ঘটনা আমাদের জীবৎকালের মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূর্যোগ । শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে এখানে । সময় এসেছে নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করার, আমরা কি সারা রাত কাফিরদের মন মাতাতে বড়দিনের গান গাইতে ব্যস্ত লোকগুলোর মত হতে চাই, যারা এভাবেই মারা গেলো এবং তাদের প্রভুর সাথে এভাবেই দেখা করবে, শিরক ও কুফরে লিপ্ত অবস্থায় ? ওখানে আপনিও থাকতে পারতেন, আজাব আপনার জনপদের উপরেও আসতে পারত । কিন্তু আল্লাহ আপনাকে সুযোগ দিয়েছেন চিন্তা করার, শিক্ষা নেওয়ার, তওবা করার । মৃত্যুর পরে তওবার কোন সুযোগ নেই । নেই ভুল পথে হেটে পাপাচারে লিপ্ত থাকার বিলাসীতার সুযোগ । সময় এসেছে আমার ও আপনার প্রভুর একনিষ্ঠ দাসত্ব করার, প্রকৃত মু'মিন হওয়ার, যার অন্তর শুধু আল্লাহর স্মরণেই প্রশস্ত্বি লাভ করে ।
সুনামির পর অস্ট্রেলিয়ান এক ইমাম ত্রানকার্জে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশিয়া যান । আচেহ প্রদেশের লক্সেউমাবে শহরে পৌছে ধ্বংসস্তুপের মাঝে হাটার সময় তিনি একটি বই খুঁজে পান, তার মনে হয় বইটির কভারে কিছু লেখা আছে । তিনি বইটি পড়তে গিয়ে যা খুঁজে পেলেন তা তাঁকে বিস্মিত করে । বইটি এক তরুণী মুসলিমাহ্ বোনের ছিল । তিনি এই বইটিকে একই সাথে নিজের ডায়েরি লেখার জন্য এবং কুরআন ও হাদীসের আয়াত লিখার জন্য ব্যবহার করতেন । বইটি শুরু হয়েছিল "বিসমিল্লাহির রহ্মানির রহীম" এবং কিছু কুরআনের আয়াত দিয়ে যা বোনটি সেই সময় হিফয্ করছিলেন । এছাড়া আরও ছিল কিছু হাদীস এবং তার ইসলামিক ক্লাসের কিছু নোট । এ ডায়েরীতে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ ঘটনাই তিনি লিখে রেখেছিলেন । বিভিন্ন রঙ ও নকশায় ডায়েরিটি অলংকৃত ছিল । সন্দেহ নেই বইটি ছিল তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বইয়ের শেষে লেখা ছিল, "I Love Islam" - আর একটি দু'আ যা সে আল্লাহর কাছে করেছিল - " আমি শাহাদাতের মৃত্যুর আশা রাখি ।"
ইমাম আশেপাশে মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, সে সুনামিতে মৃত্যুবরণ করেছে ।
আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেনঃ
وَالْغَرِقُ شَهِيدٌ
"যে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ ।"
আল্লাহর কাছে আমার দু'আ যে বোনটির দু'আ তিনি কবুল করুন, আর তাকে জান্নাতে দাখিল করুন । হতে পারে সে পৃথিবীর দরিদ্র একটি অঞ্চলের অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু আমার এবং আরও অনেকের অন্তর ছুঁয়ে গেছে তার ঘটনা । আল্লাহর প্রতি তার ভালবাসা, একজন মুসলিমাহ্ হতে পেরে তার গর্ব, তাওহীদের উপর অটল থেকে তার জীবন ও মৃত্যু এবং শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে তার আবেদন, এ সব কিছুই । তার জীবনে তার পক্ষে এটা জানা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না, কিন্তু একজন প্রকৃত মু'মিন হিসেবে সে আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই একটি প্রেরণা । আমাদের জন্য একটিই প্রশ্ন, যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন অবকাশ নেইঃ
আমরা কার মত হতে চাই ? আল্লাহর অবাধ্যতায় নিমজ্জিত থেকে, তার হারাম করা মদ পান করে, এবং কাফিরদের সাথে মিলে মিশে তাদের মত বস্তুবাদী জীবন-যাপন করতে চাই ? নাকি সেই খালেস বিশ্বাসীর মত, যে তার প্রভুর হক্ক আদায় করেছে, তাঁর উপর সন্তুষ্ট এবং ইসলামকে নিজের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট, এবং তার প্রভুর কাছে ঈমান নিয়ে সাক্ষাত করে ?
হে মুসলিম ! সিদ্ধান্ত তো তোমার হাতেই । যদি এখনও তওবা না করে থাক, আর দেরি করো না । তুমি তো জানো না তোমার জীবনে "আগামীকাল" আদৌ আসবে কিনা !
লিখেছেনঃ Brother Musa Cerantonio