পৃষ্ঠাসমূহ

আমার দেখা আনোয়ার আল-আওলাকি (রাহিমাহুল্লাহ) [প্রথম পর্ব]...

শেইখ আনোয়ার বিন নাসের আল-আওলাকি'র (রহ) সাথে আমার প্রথম দেখা হয় বরকতময় ৯/১১ এর বেশ কয়েক বছর আগে । সেটা ছিল ইসলামী পুনর্জাগরণের একদল তরুণ কর্মী, দা'য়ী এবং শিক্ষকদেরকে নিয়ে আয়োজিত ইসলামিক কনফারেন্স । আল-আওলাকি কথা বলছিলেন আল্লাহ'র দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার গুরুত্ব এবং পদ্ধতি নিয়ে । তিনি কোন কাগুজে-পন্ডিতের মতো কথা বলছিলেন না বরং স্বীয় জ্ঞান আর প্রকৃত অনুশীলনের মিশ্রণে দাওয়াতকে আত্মস্থ করা এক বাস্তব দা'য়ীর মতোই কথা বলছিলেন । ফলে আগত দর্শকদের মাঝে তার বক্তব্যের প্রভাব পড়ল ব্যপক, সবাই তার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করছিল । তারপর, তিনি দূরে চলে গেলেন, ফিরে এলেন অনেক বছর পর - তবে এবার তার সাথে আমার বেশ গাঢ় একটা সখ্য তৈরি হল । আমরা প্রতিবেশী ছিলাম, একই মসজিদে নামায পড়তাম (আল-আনসার মসজিদ) । মাঝে মাঝে তিনি জুমা'র খুতবা দিতেন, মাঝে মাঝে আমি দিতাম । পরে তার বাসার ঠিক পাশেই আল-মুমিনীন মসজিদ তৈরি হয়, তিনি সেখানেই নামায পড়তেন এবং জুমা'র খুতবা দিতেন । সেখানে কয়েকবার বক্তব্য দেয়ার জন্যে আমাকে দাওয়াতও করেছেন তিনি ।


জ্ঞানের গভীরতা

কোর'আন এবং সুন্নাহ'ই যে সহীহ ইলমের উত্স - এই সত্যকে শেইখ আনোয়ার ভালভাবেই বুঝতেন আর তাই সবসময় কোর'আনকে শেখা এবং জানার নিমিত্তেই ব্যস্ত থাকতেন তিনি । কোর'আন তেলাওয়াতের জন্যে তার উচ্চ-স্তরের ইজাজাহ ছিল । তিনি ইবন-কাসির এবং সায়্যিদ-কুতুব রচিত তাফসীর গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেছেন । হাদীস-শাস্ত্রেও তিনি ছিলেন নিবিড় জ্ঞান-তাপস, তার অনেকগুলো ভ্রমণের মধ্যে একটি ছিল সহীহ আল-বুখারী শোনার জন্যে । মূল উত্স থেকে সরাসরি হাদীস উল্লেখ করার জন্যে ইজাজাহ লাভ করেন তিনি । শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ফিকহের শিক্ষা নিয়েছেন তিনি এবং শাফেয়ী ফিকহের ওপর ইজাজাহ অর্জন করেন । যার ফলে শেইখ আনোয়ারের ইলম ছিল সহীহ উত্স এবং উম্মার শ্রেষ্ঠ ইমামদের সমন্বয়ে পরিপক্ক । আমি নিজেও তার সাথে কিছু কিছু মাশায়েখের কাছে বিশেষত ফিকহ-শাস্ত্রে একসাথে পড়াশোনা করেছি । তিনি বই পড়া খুব পছন্দ করতেন এবং আত্মার-শুদ্ধি বিষয়ক বই, বিশেষ করে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের 'মাদারিজ আল-সালিকিন' ও 'যা'দ আল মাআ'দ' গভীর ভাবে অধ্যয়ন করতেন । শায়খুল-ইসলাম ইবন তাইমিয়া'র 'মাজমু' আল ফাতাওয়া' পড়েছেন তিনি আর মাঝে মাঝেই আল-সারখাসী'র 'শার' আল সিয়ার' এবং ইবন আন-নুহাস এর 'মাশারী আল-উশওয়াক'এ চোখ বুলাতেন । ইতিহাস পড়া এবং অবলোকন করা ছিল তার নেশা; তিনি ইবন কাসির'র 'আল বিদায়া ওয়া আন-নিহায়া' এবং ইবন আল আসির রচিত ইতিহাস গ্রন্থ পড়েছেন, মাহমুদ শাকের'র 'আত-তারিক আল-ইসলামী' থেকেও উপকৃত হয়েছেন । এছাড়াও আল-সাল্লাবীর লেখা বেশিরভাগ ইতিহাস গ্রন্থই পড়েছেন তিনি এবং কিছু কিছু পর্যালোচনাও করেছেন । ক্রুসেডারদের ওপর অনেক ইংরেজী বইও পড়েছেন তিনি । ইসলাম এবং ইউরোপিয়ান উভয় ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণণা, সৈন্য সংখ্যা, সেনাপতিদের নাম এবং ফলাফল ইত্যাদি নিয়ে তথ্যগত তুলনা দক্ষতার সাথে তুলে ধরতেন তিনি । শেইখ আনোয়ার স্বভাবজাত পড়ুয়া ছিলেন । পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে শুধুমাত্র নামায এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া নিজের অফিস থেকে বের হতেন না খুব একটা । তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, একদিনেই আল-আ'মদাহ পড়ে শেষ করেছেন । শেইখ আনোয়ার ইলম অর্জন করেছেন ইলমের দায় রক্ষা করে, তিনি জানতেন ইলম হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগের জন্যে । যার ফলে মহান আল্লাহ তাকে এমন অনেকের থেকে উচ্চ-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন যাদের ইলম কন্ঠ-নালী পর্যন্তই আটকে গেছে । ইলম এবং ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে উচ্চ-মর্যাদায় আসীন করেন, মহান আল্লাহ বলেন -

 " তোমাদের মধ্যে যারা মু'মিন ও জ্ঞানপ্রাপ্ত আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচু করে দেবেন... (৫৮ : ১১) "।

শেইখ আনোয়ারের জ্ঞানার্জন এবং ইসলামী পড়াশোনা সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার একটা অতি সংক্ষিপ্ত রূপ এখানে তুলে ধরলাম । আমি যা কিছু উল্লেখ করতে পারিনি তা পরিমাণে যা উল্লেখ করলাম তার থেকে অনেক বেশি এবং আমি যা কিছু জানিনা তার পরিমাণ আমার জানার থেকে অনেক বেশি । নানাবিধ বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান'ই এই বাস্তবতার নিদর্শন । 

চলবে ইনশাআল্লাহ...

মূল লেখাঃ শাইখ হারিস আল নাযারী [ ইন্সপায়ার ম্যাগাজিন, পষ্ঠা ৯, ইস্যু ৯ ]
অনুবাদঃ শায়খ আযযাম বাংলা অনুবাদ টীম।