পৃষ্ঠাসমূহ

আমি কিভাবে ইসলামে প্রবেশ করলাম!



পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি
          
আমার বাবা প্রচণ্ড ভাবে খ্রিষ্টিয়ানিটির প্রতি মনোনিবিষ্ট ছিলেন । আমি যখন ছোট শিশু ছিলাম তখন আমার বাবা আমাকে বাইবেল থেকে নবীদের গল্প শোনাতেন, এসব নবীদের গল্পের মধ্যে ছিল নবী ইব্রাহীম, মূসা, এবং ঈসা (আল্লাহ্‌ তাদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন) এর গল্প । গল্প শুনতে শুনতে এসব নবীদের প্রতি ভালোবাসা এবং আমার বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ জন্মাতে শুরু করে । আমি যখন পরিণত বয়সে উপনীত হতে শুরু করলাম আমি আমার মনের ভিতর অস্থিরতা অনুভব করতাম। আমি সবসময়ই অনুভব করতাম আমার জীবনে কিছু একটা যেন অনুপস্থিত, কিন্তু কিসের অনুপস্থিতি তা বুঝতে পারতাম না । আমি সবসময় আমার নিষ্পাপ শিশুকালের সময়টাতে ফিরে যেতে চাইতাম, এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো আমার পরিস্থিতি ততই খারাপ হতে লাগলো । আমার চরিত্রের একটা সংশোধন খুব প্রয়োজন ছিল কিন্তু সংশোধনটা কিভাবে হবে তা আমার জানা ছিল না ।


আমি আমার চারপাশের এবং সমাজের মানুষদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে তাদের মাঝে একজন ভিনদেশী বা অপরিচিত এই অনুভূতি উপলব্ধি করতাম । আমি যখন কোন বিয়ের বা অন্য কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতাম তখন আমার চারপাশের সকলের দিকে তাকিয়ে দেখতাম আর অবাক হয়ে ভাবতাম আমি এখানে কি করছি ? আমি নিশ্চিত ভাবে জানতাম জীবনে এসবের থেকে আরও বেশী কিছু করার আছে । যখন আমি আমার অনুভূতির কথা আমার মাকে বললাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোথায় নিজের ভিতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি ? আমার মা আমাকে আরও বললেন,তুমি যদি জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও তবে তোমাকে অবশ্যই অন্যদের সাথে মানিয়ে তাদের মত করে চলতে হবে । আমার মায়ের উপদেশ আমার কোন উপকারেই আসে নি । আমি জানতাম এই জীবন আমার জন্য না কিন্তু আমার জানা ছিল না এছাড়া আর কি বিকল্প আমার আছে ? আমি কোন আশার আলো দেখতে পেতাম না । আমি হতাশার গভীর থেকে গভীর তলিয়ে যেতে লাগলাম, এমনকি কখনো কখনো আত্মহত্যার চিন্তাও করতাম ।

ঠিক এই সময়ে সেই ঘটনাটা ঘটে যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা । মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত এবং আমি অর্ধচেতন অবস্থায় হাটতে থাকতাম, ভাবতাম এখন বুঝি দিনের আলো জ্বলছে । আমি কি বলছি এবং কি করছি তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু আমি আমাকে থামাতে পারছিলাম না এবং কেন এমন হচ্ছে তাও বুঝতে পারছিলাম না । আমার মনে হচ্ছিল আমি মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছি এবং অবশেষে তা পরিণত হতে শুরু করেছে । দিনের বেলায় আমি স্বাভাবিক থাকতাম এবং এর ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে এটা ছিল একটা রসিকতার ব্যাপার । যদিও আমার মা আমাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য জোর করত কিন্তু তার প্রতিক্রিয়াও ছিল অন্য সবার মত । আমার মা হাসত এবং বলত আমি ঘুমের মধ্যে হাটি, এবং আমি যেন ঘুমাতে যাবার আগে কিছু গরম পানীয় পান করি । কেউ বুঝত না কতটা ভয়ের মধ্যে আমি ছিলাম, প্রতিটা মুহূর্তে আতংকে থাকতাম, জীবনে যেন অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো ।

এর কিছু দিন পর, যখন আমি ঘুমের মধ্যে ছিলাম তখন আমি ঐ সত্ত্বার মুখ দেখতে পেলাম, ওটা পুরোপুরি মানুষ ছিল না । ওটার ত্বক ছিল সবুজাভ-কালো ঈষৎ রঞ্জিত এবং ওটার মাথায় কিছু একটা ছিল । ওটার মুখ আমার থেকে বেশ দূরে এক পাশে ফিরানো ছিল । এরপর ওটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো, ওটার চোখ ছিল হলুদাভ বাদামী রঙের । আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম এবং তাকিয়ে দেখলাম ও ওর মাথা পিছনে দিকে ছুড়ে মারছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, যা ছিল এক পাপী শয়তানি হাসি । আমি শুধু চিৎকার, হাসি সহ বিভিন্ন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এবং আরও শুনতে পাচ্ছিলাম গানের সুরে কিছু একটা অনবরত পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিন্তু সেটা কিসের সুর তা আমি বুঝতে পারছিলাম না ।

আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম এবং বাতি জ্বালিয়ে দিলাম । এটা কোন দুঃস্বপ্ন ছিল না । আমি পুরোপুরি সচেতন ছিলাম এবং ঐ শব্দটা তখনও ছিল । আমি আমার হাত দিয়ে কান ঢেকে চিৎকার করতে শুরু করলাম আর ঘরের মধ্যে উন্মত্তভাবে দৌড়াতে লাগলাম যেন শিকারি কুকুরের মত ধেয়ে আসা তীব্র শব্দ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারি । আমি আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের ওঠাতে চেষ্টা করলাম । কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পেল না । আমি চিৎকার দিয়ে দিয়ে মাত্রাতিরিক্তভাবে অনবরত কাঁদতে লাগলাম কিন্তু শব্দটা কিছুতেই প্রশমিত হচ্ছিল না । আমি এমন ভয় অনুভব করছিলাম যা আমি পূর্বে কখনও কল্পনাও করিনি । কেউ আমাকে সাহায্য করলো না, আমি পুরোপুরি একা এবং কিছু করার শক্তিহীন । 

আমি হাত দিয়ে আমার মুখ ও কান ডেকে যন্ত্রনায় ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং বেপরোয়া হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম ; “হে ঈশ্বর ! দয়া করে আমাকে সাহায্য কর ! আমি যত ভুল ও অন্যায় করেছি তার জন্য আমি দুঃখিত । হে ঈশ্বর ! তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব, তুমি আমাকে যে পথে পরিচালিত করতে চাও আমি সে পথেই চলবো কিন্তু তোমাকে অবশ্যই এখন আমাকে সাহায্য করতে হবে । হে ঈশ্বর ! আমি জানি না তুমি আমাকে কি করতে বলছ ।” আমি এভাবে আমার প্রার্থনা বারবার করতে থাকলাম ।

এরপর হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল । শব্দটাও আর রইল না এবং আমি অনুভব করলাম চারপাশের আবহ পরিবর্তন হয়ে গেছে কিন্তু আমি এতটাই ভয়ে ছিলাম যে আমি তখনও কাঁদছিলাম এবং ঘরের চারদিকে তাকানোর মত সাহস পাচ্ছিলাম না । কিছু সময় পর সাহস সঞ্চয় করে আমি মুখ থেকে আমার হাত সরিয়ে দেখলাম সবকিছুই তখন শান্ত, নির্মল । ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করেছেন ।
প্রকৃতপক্ষে ঠিক কি ঘটেছিল এবং আমি কেমন অনুভব করছিলাম তা অন্যকে বুঝানো ছিল খুবই দুঃসাধ্য । একজন মানুষ এরকম পরিস্থিতি ঠিক তখনই বুঝতে পারবে যদি তার নিজেরও কখনও ঠিক একই ধরণের পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা থেকে থাকে । এই ঘটনার কিছু দিন পর আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে ঘটনার সময় আমি কি পরিমাণ ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে আমি দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে গেলাম । 

এভাবে কিছুদিন পার হওয়ার পর, রামাদান মাসে আমি বাসায় টিভির সামনে বসে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেল ঘুরাচ্ছিলাম । আকস্মিক ভাবে আমি একটা আরব চ্যানেল গেলাম যেখানে মক্কার কাবা থেকে সরাসরি নামায দেখাচ্ছিল । নামাযের এই ছবি আমাকে নাড়িয়ে দিল, মানুষ একজনের পাশে আরেকজন দাড়িয়ে বাঁকা হচ্ছে,গভীর শ্রদ্ধায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একই রকম পোশাক পরে একই ঈশ্বরের ইবাদত করছে,এক সত্যিকারের ঈশ্বরের ইবাদত । এখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল । এটা আমার কাছে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখার মত মনে হল যেখানে আমি সত্যিকারের আমাকে দেখতে পেলাম । 

আমি লাইব্রেরীতে গেলাম এবং কোরআনের একটি অনুবাদ নিলাম আমি জানতাম না আমি ঠিক কি খোঁজার চেষ্টা করছি কিন্তু কোরআন থেকে আমি যা পড়ছিলাম তাই আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিল এবং আমার সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেল । আমি ঈসা (আ.) এবং তার মা মেরি সম্বন্ধে পড়া শুরু করলাম । এর আগে আমি কখনও ভাবি নি যে ঈসা (আ.) ইসলামেরও নবী, সত্যিকথা বলতে আমার এই ধারণা ছিল যে মুসলিমরা ঈসা(আ.) কে অপছন্দ করে । এরপর আমি নবী লুত এবং সুলাইমান (আ.) এর কিছু আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলাম । ঈশ্বর তাদেরকে মহান নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যা বাইবেলের বিপরীত । এমনকি পূর্বে আমি এটাও বুঝতে পারতাম না, যেসব নবীদের আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পাঠানো হয়েছে সেইসব নবীরাই কিভাবে এমন সব অপরাধ করতে পারেন যা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট তাদের নামে বর্ণিত হয়েছে । এটা ছিল আমার কোরআনের সাথে প্রথম মুখোমুখি হওয়া । কোরআন পড়ে আমার যে শুধু আনন্দ আর বিস্ময়ের অনুভুতি হয়েছিল তা নয় বরং আমার এক স্বস্তির অনুভূতি হয়েছিল । আমি কখনো জানতাম না এরকম একটি বই রয়েছে যা সত্য হওয়ার যথাযোগ্য দাবিদার ।

আমি সত্যিই বিশ্বাস করি আল্লাহ্‌ (সুবহানুওয়াতায়ালা) প্রত্যেক মানুষের জীবনে কোন না কোন ভাবে তার নিদর্শন দেখাবেনই । প্রত্যেক মানুষই তাদের অন্তরের গভীর থেকে আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের সত্যতা সম্বন্ধে জানে যদিও বাইরে থেকে তারা অনেক সময় এই সত্যকে লুকানোর চেষ্টা করে ।
আমার জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি যখন আমি ধর্ম নিয়ে চিন্তা করা শুরু করি তখন আমার কাছে কখনোও ইসলাম নিয়ে চিন্তা করবো এমনও মনে হয়নি । এটা হতে পারে এ কারনে যে ইসলাম নিয়ে অন্তরের ভিতর একটা ভয় ছিল অথবা যাকে বলে ইসলামজ্বরে আক্রান্ত হওয়া । যখনিই আমি দাড়িওয়ালা ইসলামী পোশাক পড়া কোন পুরুষ অথবা কোন হিজাব পরা মহিলাকে দেখতাম তখন আমি আতংকিত অনুভব করতাম । মুসলিমদের দেখলেই আমার মৌলবাদী, হিংস্র এবং সন্ত্রাসী এই শব্দগুলো মাথায় আসত । নিজে সত্য অনুসন্ধানের বদলে আমি আমার চিন্তার ভার মিডিয়ার উপর দিয়েছিলাম ।  

আমি ধর্ম নিয়ে এভাবে চিন্তা করতাম যে, ধর্ম প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন অর্থ বহন করে না, বরং তুমি ধর্মে শুধুমাত্র বিশ্বাস করবে, ধর্ম নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করা বা খুব বেশি প্রশ্ন করবে না । এমনকি আমি এটারও ভয় করতাম, যদি আমি উচ্চশিক্ষিত হই বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই তবে শেষ পর্যন্ত আমি নাস্তিক হয়ে যাব ! কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, আমি ইসলামের যতই গভীরে প্রবেশ করি আমি ততই অনুভব করি কি চমৎকার জীবন ব্যবস্থা এই ইসলাম । ইসলামের নীতি, বিধি-বিধান গুলো ন্যায়পরায়ণ এবং অতুলনীয় । ইসলাম হচ্ছে সত্য, বিশ্ববাসীর জন্য সার্বজনীন বার্তা এবং আল্লাহ্‌ (সুবাহানুওয়াতায়ালা) এর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ । সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য আমাকে এই সত্য উপলব্ধির সুযোগ দেয়ার জন্য ।

বোন S.B, UK      


মূল লেখাঃ  http://www.kalamullah.com/nonmuslims05.html

অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত