পৃষ্ঠাসমূহ

একাকিত্বঃ একটি অভিশাপ এবং মুক্তির উপায়...



প্রশ্নঃ আমি মানুষের সাথে মেলামেশা সহ্য করতে পারিনা এবং একাকি থাকতে পছন্দ করি যখন আমি অন্যদের সাথে মেলামেশি করি তখন মনে হয় যেন চরম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় আছি রাসূল (সঃ) আমাদের মসজিদে সালাত আদায় করার আদেশ দিয়েছেন আমার কি করা উচিত? মসজিদে প্রার্থনা করার চেয়ে না করাই আমার কাছে শ্রেয় হয়ে দাড়িয়েছে


উত্তরঃ সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের


প্রথমতঃ

যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন এটা শুধু মাসজিদে সালাত আদায় করার ক্ষেত্রেই না বরং এটা আপনার অনান্য কর্মকান্ড করার সময়ও, যেগুলো আপনাকে বাসার বাইরে যেয়ে করতে হবে  যেমন; আপনার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, আপনার প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করতে, জ্ঞান অর্জন করার ক্ষেত্রে, সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করা এবং এই রকম আরো অনেক ক্ষেত্রে



শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেনঃ

মেলামেশার করার বিষয়টি কখনও ফরয (বাধ্যতামূলক) আবার কখনও মুস্তাহাব মাঝেমাঝে একজন ব্যাক্তিকে অন্যকারোর সাথে মেলামেশা করতে হতে পারে আবার মাঝেমধ্যে তাকে একাকী থাকতে হতে পারে এটা নির্ভর করে উদ্দেশ্যের উপর অন্যের সাথে যদি মেলামেশা হয়ে থাকে ন্যায়নীতি ধার্মিকতার বিষয়ে একে উপরকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে তাহলে এটা নির্দেশ করা হয় কিন্তু এটা যদি হয়ে থাকে পাপ সীমালংঘনের কাজে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে তাহলে এটা নিষিদ্ধ করা হয় মুসলিমদের সাথে চলাফেরা করা এক প্রকার ইবাদাহ, যেগুলি সংঘটিত হয় প্রাত্যাহিক পাচ ওয়াক্ত সালাতের ক্ষেত্রে, জুমুআহ, ঈদ, সূর্যগ্রহনের সালাত, বৃষ্টির জন্য সালাত এবং ইত্যাদি অনান্য বিষয়ে এগুলো সেসব বিষয় যা আল্লাহ তার রাসূল (সঃ) আদেশ করেছেন হজ্জের জন্য একই আদেশ প্রযোজ্য অন্যদের সাথে মেশার ক্ষেত্রে, এছাড়াও কুফফার এবং বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধের সময়, এমনকি যদি তার নেতা মন্দলোকও (ফাসিক) হয় এবং এমনকি যদি মানুষের ভিতর কিছু মন্দলোকও সেই কাজে সম্পৃক্ত থাকে


একই নির্দেশ প্রযোজ্য কোন জনসমাবেশে যোগদান করার ক্ষেত্রে যেটা একজন ব্যক্তির ঈমানকে বৃদ্ধি করে, এইসব জনসমাবেশ থেকে হয়ত সে নিজে উপকৃত হবে অথবা সে অপরকে উপকৃত করবে, ইত্যাদি বিষয়সমূহে (মাজমুয়াল ফাতওয়া, ১০/৪২৫)


সুতরাং আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, আপনি এমন এক পরিস্থিতিতে আছেন  যা এই বিশ্বজগতের মালিককে সন্তুষ্ট করছেনা, তাই আপনাকে বিষয়টির প্রতি পূনরায় দৃষ্টি দিতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে যে, আপনি যা করছেন এটা শয়ত্বানের পক্ষ থেকে একটা কৌশল যে আপনার এই অবস্থা তৈরী করছে আর আপনার খারাপ কাজকর্মগুলো আপনার কাছে ভাল হিসেবে উপস্থাপন করছে শয়ত্বান এবং তার কৌশল সম্পর্কে সতর্ক হউন এবং প্রস্তুত হউন তাকে প্রতিহত করার জন্য আর বিশ্বাস করুন যে আপনার রব আপনাকে সাহায্য করবেন তার বিরুদ্ধে বিজয় দানের মাধ্যমে

দ্বিতীয়তঃ
যদি আপনি মানুষের সাথে মেলামেশা করতে যন্ত্রনা অনুভব করেন তাহলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, একাকী থাকলেও আপনি কখনোই আপনার নিজের উপর ভালো হতে পারেন না নেকড়ে যেমন দলছুট ভেড়াকে খেয়ে নেয় ঠিক তেমনি যারা নিঃসঙ্গভাবে থাকে শয়ত্বান সমস্ত শক্তি দিয়ে তাদের পরাভূত করে কারন আল্লাহকে মেনে চলার ক্ষেত্রে সাহায্য করার মত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই এমনকি শয়ত্বান তার সৈন্যসামন্তের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন করার মত কোন সমর্থনকারীও নেই এমনকি যদি জনতার সাথে মিশতে (উপরের বর্ণিত কোন কাজে) আপনি কোন বিরক্তিকর বিষয় লক্ষ্য করেন আর সেটা যদি ধৈর্যশীলতার সাথে সহ্য করেন তথাপি একাকী থাকার চেয়ে এটাই শ্রেয় রাসূল (সঃ) সেই ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন যে মানুষের সাথে মেলামেশা করে এবং তাদের বিরক্তিকর বিষয়সমূহ ধৈর্যের সাথে সহ্য করে


এটি বর্ণিত হয়েছে ইবন উমার থেকে, তিনি বলেনঃরাসূল (সঃ) বলেছেন মুমিনদের মধ্যে যে মানুষের সাথে চলাফেরা (মেলামেশা) করে এবং তাদের বিরক্তিকর বিষয়গুলো সবরের সাথে সহ্য করে তার জন্য অধিকতর পুরস্কার তার চেয়ে যে মানুষের সাথে মেশেও না এবং তাদের বিরক্তিপূর্ণ বিষয়সমূহের সাথেও যুক্ত হয়নাহাদীসটি গ্রহন করেছেন আত-তিরমিযি (৫২০৭) এবং ইবনে মাজাহ (৪০৩২)


তাছাড়াও আপনার একাকী থাকার কোন কারন নেই আর আপনি এটা করতে পারেন না এছাড়াও যতদূর আমরা দেখতে পারি এমন কোন বিবেচনা নেই যার কারনে আপনাকে একাকী থাকতে আমরা উৎসাহিত করতে পারি আমরা মনে করি যে, একাকীত্বের কারণে আপনি জুমু’আহ পড়ছেন না যা গ্রহনযোগ্য নয় কারন এটা একত্রে পড়তে হব এবং আমরা এটাকে উৎসাহিত করিনা

একাকী থাকার কিছু কারনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যেখানে সমস্ত মানুষ দূর্নীতিগ্রস্ত, যেখানে আপনাকে সত্যের পথে অটল থাকতে সমর্থন করবে এরকম মানুষের অভাব, যেখানে প্রতিটা ব্যক্তিই তাদের নিজেদের মতামত নিয়ে উল্লাসিত, যেখানে আন্তরিকতার সাথে নসীহাহ (সৎ উপদেশ) করার উপকারিতার অভাব আল্লাহর দয়ার শপথ, এগুলোর কোনটিই মুসলিম সমাজে প্রযোজ্য না এমনকি কাফির সমাজেও না কারন আমরা বহিত হয়েছি হাজার হাজার কাফির অবিরতভাবে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে এবং আমরা তাদের মত অন্যদেরকেও শুনেছি যারা পাপী বা সীমালঙ্ঘনকরী তারা সত্যের পথ অনুসরণ করা শুরু করেছে আধ্যাত্বি ভালোত্ব পথনির্দেশের ক্ষেত্রে যারা তৃষ্ণার্ত তাদের জন্য যারা তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করবে এবং যারা ক্ষুদার্ত তাদের জন্য যারা তাদের ক্ষুদা নিবারণ করবে, বস্তুত আমরা তাদেরই অনুসন্ধান করি

একাকী থাকার জন্য আপনার জাস্টিফিকেশান প্রসংগে, শরীয়াহ জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা মনে করি না এটা সেই ক্ষেত্র যে সব ক্ষেত্রে মিলামেশা বাধ্যতামূলক (ফারদ) সেসব ক্ষেত্রে আপনি একাকী থাকা অধিকতর শ্রেয় মনে করছেন, তাই যদি আপনি নিঃসঙ্গ থাকার জন্যে ইসলামিক কর্তব্য অবহেলা করেন, তাহলে কোন প্রকারের শরীয়াহ জ্ঞান আপনার কাছে আছে যার কারনে আমরা আপনাকে জনগণ থেকে পৃথক থাকতে বলতে পারি এবং আপনার রবের আনুগত্যের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে আপনাকে নিবন্ধ করতে পারি  


কারনে আবু সুলায়মান আল-খাত্তাবি (রহঃ) বলেনঃ একাকী শুধুমাত্র উপকৃত করে বিদ্বান (স্কলার) জ্ঞানী ব্যক্তিদের কিন্তু অজ্ঞ লোকদের জন্য এটা খুবই ক্ষতিকর বিষয় আর তিনি ইব্রাহীম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মুগীরাহ কে বলেন, ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন কর তারপর তুমি নিজেকে পৃথক করতে পার (একাকীত্ব বেছে নিতে পার) দেখুনঃ আল খাত্তাবির লেখা আল আজলাহ, পৃষ্টা নং ২২৫


তৃতীয়তঃ

আমরা এটাকে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করি যে আপনি আমাদের কাছে লিখেছেন- এটার অর্থ দাঁড়ায় যে আপনি এখনো বিপজ্জনক অবস্থার উপর আছেন এবং মারাত্নক এই নিসঃঙ্গতা থেকে আপনি নিজেকে সঠিক পথে আনতে শুরু করছেন এখন আপনি ইন্টারনেটের ভূবনে প্রবেশ করেছেন যেটা লক্ষ গুন বড় আপনার ক্ষুদ্র পৃথিবীর চেয়ে যা আপনি পরিত্যাগ করেছেন এই বিশাল পৃথিবীতে অনেক বেশি পাপ ছড়িয়ে রয়েছে আপনার পরিত্যাগকৃত ভূবনের চেয়ে সুতরাং এই বিষয়ে সতর্ক হউন যে এটা কতোটা প্রলোভন তৈরী করেছে ন্যায়বান লোকদের জন্য এবং কতোখানি খারাপ ঘটিয়েছে ন্যায়নিষ্ঠাবান সৎ নারীদের জন্য


সংগ্রাম করুন আল্লাহর (সুবঃ) ইবাদত (বিধি বিধান গুলো পালন )করার জন্য যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে সর্বপ্রথমে মাসজিদে জামাতে সালাত আদায় করা এছাড়াও আপনার মর্যাদা রক্ষা করতে এবং মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে আপনাকে হালাল উপার্জন করতে হবে এবং যাতে আপনি আপনার মাতাপিতাকে সম্মান করতে পারেন, তাদের যত্ন নিতে পারেন, তাদের যা প্রয়োজন তা কিনে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন, তারা যেখানে যেতে চায় সেখানে নিয়ে গিয়ে সাহায্য করতে পারেন আর আপনার পরিবার আত্নীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বা দৃড় বন্ধন বজায় রাখতে পারেন


আপনার মনে রাখা উচিত যে, এই দুনিয়া কখনই দূর্ভোগ, দুশ্চিন্তা দুর্দশা মুক্ত হবে না যদি আপনি এরকম একটি স্থান পেতে চান যেখানে র কোনটিই নেই, আছে শুধু পরিপূর্ণ সুখ শান্তি, একটি সুন্দর ভালো জীবন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাহলে আপনি এটা একমাত্র পরকালে আল্লাহর (সুবঃ) জান্নাতে পাবেন সুতরাং সেই দিনের জন্য সংগ্রাম করতে থাকুন এবং এই দুনিয়ায় যে সব বিষয় আপনার যন্ত্রনা সৃষ্টি করে সেইসব বিষয়ে সম্পৃক্ততা কমানোর মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করুন আর তা অর্জন করার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন এবং মনে রাখবেন নিজেকে একাকি করে রাখা আর একজন শয়ত্বানের সাথে থাকার চেয়ে বেশি কিছু নয় আর এটা শুধু আপনার দুশ্চিন্তা দুর্দশাই বয়ে আনবে আপনি কি লক্ষ্য করেন না যে, মুক্ত মানেষের জন্য কারারুদ্ধ করার শাস্তি কতোটা বেদনাদায়ক এবং একাকী অবরুদ্ধ এটার সবচেয়ে সঙ্কটজনক অবস্থা ? সুতরাং কিভাবে আপনি নিজের জন্য সেটাকে শ্রেয় মনে করেন যার থেকে মুক্তির জন্য বন্দীরা তাদের নিকট সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে ?


আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনাকে সত্যের দিকে পরিচালিত রেন এবং তার বান্দাদের ভিতর যাদের তিনি হেদায়েত দান করেছেন তাদের পথ অনুসরণ করতে সাহায্য করেন এটা বিষয়বস্তু না যে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তোমাদের উচিত মানুষের সাথে মেশা আর আল্লাহর বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করা বরং বিষয় এটাই যে আমরা আপনারা কেউই ইসলাম সম্পর্কে জানিনা এবং এটাতে দাখিল হওয়ার সম্মান সম্পর্কেও অবগত নই তাই ইসলামের সৈন্যগণের একজন হউন, শয়ত্বানের মুখে আপনার অস্ত্র ব্যবহার করুন এবং একাকী কঠিন সংগ্রামের কারনে যেগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করুন আর নির্ভরযোগ্য ভিত্তিতে আল্লাহর ইবাদতগুলো করতে থাকুন


বস্তুত আল্লাহই (সুবঃ) শক্তিমত্তার উৎস। 


মূল লেখাঃ শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ 
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত