প্রশ্নঃ কিভাবে একজন মানুষ এই দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা ও
সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে? ইসলাম উম্মাহকে এই
দুনিয়ায় কি ধরণের সফলতা বা সমৃদ্ধি অর্জনের তাগিদ দেয়?
উত্তরঃ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।
উত্তরঃ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।
অন্তরের প্রশান্তি, আত্মতৃপ্তি, সুখ এবং দুশ্চিন্তা ও
অনিশ্চয়তাবোধ থেকে মুক্তি
... এই বিষয়গুলো প্রত্যেকেরই
কাম্য আর এগুলোই মানুষকে একটি সুন্দর জীবন উপহার দেয় এবং
সেই জীবন হয় সুখের, আনন্দের। এগুলো অর্জন করার কিছু ধর্মীয় পদ্ধতি আছে, আবার কিছু প্রাকৃতিক ও বাস্তবিক পদ্ধতিও আছে। কিন্তু একমাত্র
ঈমানদার ছাড়া আর কেউই এগুলোর সন্নিবেশ করতে পারে না। যদিও হয়তো অনেকে এগুলোর অনেক
কিছুই অর্জন করতে পারে কিন্তু তারা একসাথে এ সব কিছুই অর্জন করতে পারে
না।
নিচে মানুষ
যে লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করে জীবন
সংগ্রামে রত তা অর্জনের কিছু পদ্ধতি দেয়া হলো; যারা এগুলোর বেশিরভাগই অর্জন করতে পারবে
তারা একটি সুন্দর ও আনন্দময় জীবন গড়ে তুলতে পারবে। যারা এগুলোর একটিও অর্জন করতে
পারবেনা তাদের জীবন দুঃখ ও কষ্টে ভরা জীবনে পরিণত হবে। আর এর মাঝামাঝি অবস্থানে
থাকবে তারা, যারা সেই পরিমাণই সফল হবে, যতটুকু গুণ তারা
অর্জন করতে পারবে । পদ্ধতিগুলো হলোঃ
১- ঈমান
(বিশ্বাস) ও সৎ কার্য
এটিই হলো সর্বপ্রধান এবং মূল পদ্ধতি। আল্লাহ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা)
“ যারা নেককার (সৎ আমল করে) – পুরুষ হোক বা নারী – সে যদি সত্যিকারের বিশ্বাসী হয় (তাওহীদে বা আল্লাহর একত্ববাদে) তবে আমি অবশ্যই তাকে (দুনিয়ায়) পবিত্র জীবন যাপন (সম্মান, সন্তুষ্টি এবং হালাল রুজি) উপহার দেবো, এবং তাকে তার ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করবো (আখিরাতে জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে)।”
[ সুরা নাহল ১৬:৯৭]
আল্লাহ আমাদের ওয়াদা করেছেন, কোন ব্যক্তি যদি একই সাথে ঈমানদার এবং সৎকর্মশীল হয় তবে তাকে এই দুনিয়ায় ও আখিরাতে একটি উত্তম জীবন ও উত্তম পুরস্কার প্রদান করা হবে।
এর কারণ পরিষ্কার; যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে – এবং সেই
বিশ্বাস এতোই শক্তিশালী যে তা তাদের সৎ কাজ করতে প্রণোদিত করে যা অন্তকরণ ও
চরিত্রকে পরিবর্তন করে দুনিয়া ও আখিরাতে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সোজা পথে পরিচালিত
করে – তাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা, হোক সেটা খুশি ও উত্তেজনার বা হতাশা, দুশ্চিন্তা
ও দূর্দশার কারণ, এই মৌলিক নীতিমালা
অনুযায়ীই তারা পরিস্থিতির
মোকাবিলা করে।
তারা যে
বিষয়গুলো পছন্দ করে সেগুলোর ক্ষেত্রে তারা তা গ্রহণ করে, এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করে এবং সেগুলো কোন ভালো কাজে প্রয়োগ করে। এভাবে এই বিষয়গুলো গ্রহণ করার ফলে তাদের মাঝে একটি উত্তেজনা কাজ করে
এবং তারা আশা করতে থাকে যে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণেও ভবিষ্যতে তাদের পুরষ্কৃত করা
হবে যা এই সাময়িক সফলতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর খারাপ পরিস্থিতিতে, দুশ্চিন্তায় এবং
দুঃখ দুর্দশায় তারা যেটুকু
প্রতিরোধ করা সম্ভব তা প্রতিরোধ করে, যেটুকু উপশম করা সম্ভব সেটুকু উপশম করে আর যখন প্রতিরোধ বা উপশম করা সম্ভব হয় না তখন যথাসাধ্য ধৈর্যধারণ
করে। তাই এই ধরনের খারাপ পরিস্থিতি
থেকেও তারা উপকার, অভিজ্ঞতা, সাহস ও শক্তি, ধৈর্য ও পুরস্কার লাভের আশা অর্জন করে,
যা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহর কাছ থেকে এই কষ্টের বিনিময়ে
প্রাপ্য পুরস্কারের আশা, তাদের এই সাময়িক কষ্টকে আনন্দে পরিণত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক সহীহ হাদিসে বর্ণনা করেছেন,
“মু’মিনের অবস্থা কতই না চমৎকার! তার সব অবস্থাতেই কল্যাণ থাকে। যদি তার সাথে ভালো কিছু ঘটে, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, যা তার জন্য কল্যাণকর। আবার যদি তার সাথে খারাপ কিছু ঘটে, সে ধৈর্যধারণ করে, যা তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর এটি বিশ্বাসী (ঈমানদার) ছাড়া কারো সাথেই ঘটে না (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৯৯)।
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেন যে, ভালো খারাপ যাই
ঘটুক, একজন ঈমানদার সব সময়ই লাভবান হয় এবং তার সৎকাজের জন্য পুরস্কারের পরিমাণও বাড়তেই
থাকে।
২ – মানুষের
প্রতি কথা ও কাজে সহানুভূতিশীল হওয়া
এবং তাদের সাথে ভালো আচরণ করা। এটি
দুশ্চিন্তা, দুঃখ-দূর্দশা ও উদ্বেগ দূরীকরণের অন্যতম একটি উপায়। এর মাধ্যমে আল্লাহ
পূণ্যবান ও পাপী উভয়কেই দুশ্চিন্তা ও দূর্দশা থেকে দূরে রাখেন। কিন্তু একজন ঈমানদার এখানে বেশি লাভবান হয় এবং অন্যের সাথে তার পার্থক্য এই যে, তার এই ভালো
আচরণের জন্য সে আল্লাহর নিকট
পুরস্কারের আশা করে। আর এই একনিষ্ঠতা এবং পুরস্কারের
আশার মাধ্যমে তার জীবনে ভালো কিছু ঘটবে এবং খারাপ বিষয়গুলো দূর হয়ে যাবে – এমন আশার কারণে আল্লাহ তার জন্য কাজটি সহজ করে দেন। আল্লাহ বলেন, (আয়াতের ব্যাখ্যা)
“এদের অধিকাংশ গোপন সলাপরামর্শের ভেতরেই কোন কল্যাণ নিহিত নেই, তবে যদি কেউ (এর দ্বারা) কাউকে কোন দান-খয়রাত, সৎকাজ ও অন্য মানুষের মাঝে (সম্প্রীতি ও) সংশোধন আনয়নের আদেশ দেয়- তা ভিন্ন কথা; আর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যদি কেউ এসব কাজ করে তাহলে অতি শীঘ্রই আমি তাকে মহাপুরস্কার দেবো।” (সুরা আন-নিসা ৪:১১৪)
এই
মহাপুরস্কারের একটি অংশ হলো দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-দূর্দশা থেকে অব্যাহতি লাভ।
৩ – বিচলিত
ও বিশৃংখল চিন্তা ভাবনা থেকে উদ্ভুত উদ্বেগ থেকে দূরে রাখার আরেকটি উপায় হলো, ভালো কাজ করা বা উপকারী জ্ঞান অন্বেষনের মাঝে
নিজেকে ব্যস্ত রাখা। এটি একজন মানুষকে তার দুশ্চিন্তার কারণগুলো
থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এভাবে কোন ব্যক্তি হয়তো যে
বিষয়গুলি তার দুশ্চিন্তা বা দূর্দশা কারণ
হচ্ছে সেগুলো ভুলে যাবে, ফলে সে সুখী ও উদ্যমী হয়ে উঠবে। এটি হলো আরো একটি দিক যা
একজন ঈমানদার ও অন্য সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু এক্ষেত্রেও একজন
ঈমানদার, সে যা শিখছে বা শেখাচ্ছে বা অন্য যে
ভালো কাজগুলো করছে - তার বিশ্বাস,
একনিষ্ঠতা ও পুরস্কারের আশার
কারণে সে অন্যদের তুলনায় ভিন্ন।
যে কাজে সে
নিজেকে নিয়োজিত রাখবে তা অবশ্যই এমন হতে
হবে যেন সে ঐ কাজটি পছন্দ করে এবং কাজটি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এতে করে সে কাংক্ষিত সফলতা লাভ করতে পারবে। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
৪ – আরেকটি কাজ যা একজন ব্যক্তিকে দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখে, তা হলো ভবিষ্যতের ভাবনায় বা অতীতের কোন কিছু নিয়ে আফসোস না করে বর্তমানের উপরই সকল
মনোযোগ নিবদ্ধ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দুশ্চিন্তা ও
অনুশোচনা থেকে, অতীতের সেসব কাজ যা পরিবর্তন করা
যাবে না সেগুলোর অনুশোচনা থেকে এবং ভবিষ্যতের যে সকল কাজ ভয়ের কারণ হতে পারে তার দুশ্চিন্তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চেয়েছেন। সুতরাং একজন মানুষের
উচিত শুধু বর্তমানের দিকেই দৃষ্টিপাত করা এবং আজকের কাজটি যাতে ভালোভাবে হয় সেদিকে
মনোযোগ দেয়া। যদি কেউ বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হয় তাহলে সে সব কাজই ভালোভাবে সম্পাদন করতে পারবে এবং দুশ্চিন্তা ও আফসোস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
যখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দু’আ করেছেন বা তার উম্মাহকে
(অনুসারীদের) কোন দু’আ শিখিয়েছেন, তিনি তাদের আল্লাহর সাহায্য ও পুরস্কার লাভের জন্য দু’আ করার সাথে সাথে যা পাওয়ার
জন্য দু’আ করা হচ্ছে তা লাভের জন্যে নিজ উদ্যোগে যথাসম্ভব চেষ্টা সাধনা করতে বলতেন, কারণ দু’আ
ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজ একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং একজন মানুষের উচিত তার
জন্য দুনিয়াবী ও আধ্যাত্মিকভাবে উপকারী প্রত্যেক বিষয়ের জন্য চেষ্টা সাধনা করা এবং এর জন্য
আল্লাহর নিকট দু’আ করা এবং
তাঁর সাহায্য কামনা করা। যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“যা তোমার জন্য উপকারী তার জন্য চেষ্টা করো এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, দূর্বল হয়ো না। যদি খারাপ কিছু ঘটে তবে এ কথা বলো না যে, আমি যদি এরূপ কাজ করতাম তবে ঐরূপ হতো। বরং বলো, আল্লাহই হুকুমদাতা এবং তিনি যা চান তাই ঘটে; কেননা ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কাজের দরজা খুলে দেয়।” (মুসলিম)
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোন উত্তম কাজের সাথে ঐ কাজের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়াকে সমন্নিত করেছেন এবং নিজেকে
দূর্বল ভাবতে বারণ করেছেন কারণ তা মানুষের মাঝে
অলসতা জন্মাতে সাহায্য করে। আর অতীতের ব্যাপারসমূহ যেগুলো ইতোমধ্যেই ঘটে গিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আল্লাহর
দেয়া ফয়সালাকে স্বীকার করা ও মেনে নেয়া। তিনি দুই ধরণের বিষয়কে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেনঃ
ক) – একজন মানুষ যা কিছু অর্জন করার জন্য চেষ্টা সাধনা করে বা তার মাঝে অন্তত কোন একটা বিষয় অর্জনের চেষ্টা করে বা কোন
কিছু থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরোধ
বা তা উপশমের চেষ্টা করে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজনের অবশ্য কর্তব্য হলো তা অর্জনের জন্য
যথাসম্ভব চেষ্টা সাধনা করা এবং সাথে সাথে
আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা।
খ) – যেসব ক্ষেত্রে চেষ্টা চালিয়ে
যাওয়া সম্ভব নয়, সেসব ক্ষেত্রে শান্তভাবে এটি গ্রহণ
করে তা আল্লাহর মর্জির উপর ছেড়ে দেয়া।
নিঃসন্দেহে
এই বিষয়গুলোর
দিকে লক্ষ্য রাখলে, অবশ্যই জীবনের দুশ্চিন্তা ও দুঃখ দূর্দশাগুলো সুখ ও শান্তিতে পরিণত হবে।
৫ –
সন্তুষ্ট ও স্থির থাকার জন্য এবং মনের শান্তির জন্য আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা
(যিকর) হলো একটি অন্যতম
মাধ্যম। সন্তুষ্টি ও মনের শান্তি প্রতিবিধানে এবং দুশ্চিন্তা ও দুঃখ দূর্দশা থেকে দূরে থাকতে এর জুড়ি নেই। আল্লাহ বলেনঃ
“নিশ্চয়ই, আল্লাহর স্মরণে অন্তর প্রশান্ত হয়।” [সুরা আর-রাদ
১৩:২৮]
আল্লাহ
স্মরণ (যিকর), এর নিজস্ব প্রভাব এবং এর বিনিময়ে পুরস্কারের আশার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ
ভূমিকা পালন করে।
৬ – সুখ
শান্তি আনয়ন ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আরো একটি পদ্ধতি হলো, যে
বিষয়গুলো দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,
সেগুলো দূর করা এবং যে বিষয়গুলো মনে সুখ বয়ে আনে, তা অর্জনের চেষ্টা করা। এটি হতে পারে অতীতের পীড়াদায়ক বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করার মাধ্যমে এবং এ কথা অনুধাবন করা যে সেগুলোর পিছনে পড়ে থাকা শুধুমাত্র সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং একজন মানুষের অবশ্যই উচিত অতীতের
এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা না করা এবং একইসাথে ভবিষ্যত নিয়েও দুশ্চিন্তা না করা। ভবিষ্যতের
দারিদ্রতা, ভীতি বা অন্য যে কোন খারাপ কিছু
ঘটার কাল্পনিক ভাবনা নিয়ে অহেতুক
দুশ্চিন্তা করা থেকে বিরত থাকা।
তার উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, ভবিষ্যত একটি অজানা বিষয়, তাই
সে জানে না ভালো বা খারাপ কোনটি তার সাথে হতে যাচ্ছে। এটি শুধুমাত্র সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ আল্লাহর হাতে এবং তাঁর
বান্দাদের একমাত্র করণীয়
হলো যা ভালো, তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া এবং
যা কিছু মন্দ তা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। একজন মানুষের উপলব্ধি করা উচিত, যদি সে ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা বাদ দেয় এবং আল্লাহর উপর তার অবস্থা সম্পর্কে
ভরসা করা শুরু করে, এবং এভাবে তার মনকে ভবিষ্যত দুচিন্তা থেকে দূরে রাখে, এর ফলে তার অন্তর শান্তিতে থাকবে, তার
অবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং সে দুশ্চিন্তা ও দূর্দশা থেকে মুক্তি
লাভ করবে।
দুশ্চিন্তার
সাথে লড়াই করার অন্যতম একটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে, নিন্মোক্ত দু’আটি করা যা রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন-
“আল্লাহুম্মা আসলিহ লি দ্বীনি আল্লাযি হুয়া ‘ইসমাতু আমরি, ওয়া আসলিহ লি দুনইয়াইয়া আল্লাতি ফিহা মা’আশি, ওয়া আসলিহ লি আখিরাতি আল্লাতি ইলাইহা মা’আদি, ওয়াজা’আল আল-হায়াতা জিয়াদাতান লি ফি কুল্লি খাইর, ওয়া’ল মাওতা রাহাতান লি মিন কুল্লি শার (হে আল্লাহ, তুমি আমার দ্বীনকে সংশোধন করে দাও যা আমার জীবনের ভিত্তি, এবং আমার পার্থিব কাজকর্মকেও সংশোধন করে দাও যার উপরে আমি জীবিকা নির্বাহ করি এবং আমাকে আখিরাতে আমার প্রত্যাবর্তনে উত্তম অবস্থান দান করো। আমার জীবনকে পূণ্য অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দাও এবং আমার মৃত্যুকে সমস্ত মন্দ থেকে বেঁচে যাওয়ার অবকাশ বানিয়ে দাও।)” (মুসলিম, হাদিস নং ২৭২০)
তিনি আরো বলতেন,
“আল্লাহুম্মা রাহমাতাকা আরজু ফা লা তাকিলনি ইলা নাফসি তারফাতা ‘আইনিন ওয়া আসলিহ লি শানি কুল্লাহু, লা ইলাহা ইল্লা আনতা (হে আল্লাহ, আমি তোমার করুণাপ্রার্থী, আমাকে এক মুহুর্তের জন্যেও আমার নিজের উপর ছেড়ে দিও না। এবং আমার সকল কাজ সংশোধন করে দাও, তুমি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কোন ইলাহ নেই।)” (আবু দাউদ থেকে সহীহ ইসনাদের সাথে বর্ণিত, হাদিস নং ৫০৯০; আল আলবানী (র) দ্বারা হাসান হাদিস হিসেবে সনদকৃত, সহীহ আল-কালিম আল-তায়্যিব, পৃষ্ঠা ৪৯)।
যদি কোন
ব্যক্তি বুঝে বুঝে মন দিয়ে নিয়তের আন্তরিকতা সহ এই দু’আগুলো পড়ে যেখানে তার দুনিয়া
ও আখিরাতের সকল কাজ সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে দু’আ করা হয়েছে এবং
সাথে সাথে কল্যাণ অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাহলে সে যা পাওয়ার জন্য দু’আ করছে, আশা করছে এবং চেষ্টা সংগ্রামও করছে, আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। এবং আল্লাহ তার দুশ্চিন্তাকে সুখ শান্তিতে রূপান্তরিত করে
দেবেন।
৭ – যদি কোন
ব্যক্তি আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও দূর্দশাগ্রস্থ হয়, তাহলে তার এই কষ্ট লাঘব করার অন্যতম একটি
উপায় হতে পারে, সে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করবে যা
তার সাথে ঘটতে পারতো এবং বর্তমান অবস্থাকে মেনে নিবে। এরপর
যতদূর সম্ভব দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করবে। পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার সাথে সাথে এই কাজগুলোর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দুশ্চিন্তা, দূর্দশা থেকে মুক্তি পাবে এবং এই বিষয়ে চিন্তা করার বদলে সে
ভালো কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করবে ও খারাপের সাথে যেভাবে দরকার সেভাবেই মোকাবিলা করবে। যদি কেউ ভয় বা অসুস্থতার সম্ভাবনা বা দারিদ্রের মুখোমুখি হয়, তবে সেক্ষেত্রে
তার প্রথম কাজ হলো বিষয়টি মেনে নেয়া
বা এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করা যাতে করে যে
পরিস্থিতির সম্মুখীনই হতে হোক না কেন, তা যেন তাকে কাবু করতে না পারে এবং বিশেষ করে যতদূর সম্ভব সমস্যাগুলো দূর করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। একইসাথে ভালো কিছু অর্জনের জন্য চেষ্টা করা যা তাকে এই বিষয়গুলো থেকে দূরে সরিয়ে
রাখবে, পাশাপাশি এর মাধ্যমে সে বিপদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা লাভ করবে এবং আল্লাহর
প্রতি তার বিশ্বাস ও আস্থা আরো দৃঢ় হয়ে উঠবে। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো মানসিক সুখ ও প্রশান্তি লাভে সহায়তা করে, সাথে সাথে এগুলো দুনিয়া
ও আখিরাতে ভালো কিছু পাওয়ার আশাও তৈরি করে। এই বিষয়টি বহু মানুষের
অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত যারা এই পদ্ধতিতে সফলতা লাভ করেছে।
৮ – হৃদয়ের দৃঢ়তা
অর্জন করা এবং কাল্পনিক খারাপ চিন্তার দ্বারা বিচলিত না হওয়া। যখন মানুষ এসব কল্পনাকে তার মনে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়,
যেমন অসুস্থতার ভয় বা ক্রোধ ও বিশৃংখল চিন্তাভাবনা বা খারাপ কিছুর আশংকা এবং ভালো
কিছু হারিয়ে যাওয়ার আশংকা ইত্যাদি এগুলো তার দুশ্চিন্তা, দূর্দশা ,
মানসিক ও শারিরীক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে দিতে পারে, যা তার জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে, এমন অনেক লোকই
দেখা যায় যারা এই সমস্যায় আক্রান্ত। কিন্তু যখন কোন
মানুষ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, তাঁর উপর বিশ্বাস রাখে, এসব অমূলক কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয় না, আল্লাহর উপর
আস্থা রাখে এবং তাঁর কাছ থেকে পুরস্কারের আশা পোষণ করে সেক্ষেত্রে তার দুশ্চিন্তা ও দূর্দশা দূরীভূত হয়ে যায় এবং মানসিক ও
শারিরীক বিভিন্ন ব্যাধি থেকে অনেকাংশে
তাকে রক্ষা করে। এটি হৃদয়কে অবর্ণনীয় শক্তি, স্বস্তি ও আনন্দ প্রদান করে। বেশির ভাগ
হাসপাতালই মানসিকভাবে এই
ধরণের খারাপ চিন্তা ও ক্ষতিকর কল্পনায় আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা
পূর্ণ হয়ে আছে, কত সহসাই না
দুশ্চিন্তা অনেক শক্ত মনের মানুষদেরও কাবু করে ফেলে, দূর্বলদের কথা না হয় বাদই
দিলাম, আর কত সহজেই না তারা মানুষকে নির্বোধ আর পাগল বানিয়ে ছাড়ে।
এখানে অবশ্যই লক্ষণীয় যে, আপনার জীবন আপনার চিন্তাভাবনাকে অনুসরণ করেই এগিয়ে যাবে। আপনার চিন্তা যদি হয় এমন কিছু যা আপনাকে আধ্যাত্মিক বা পার্থিব বিষয়ে লাভবান করতে পারে, তাহলে আপনার জীবন হবে সুখী এবং সুন্দর। অন্যথায়, তা হবে ঠিক এর বিপরীত।
ঐ ব্যক্তিই এসব থেকে নিরাপদ রয়েছেন যাকে আল্লাহ সুরক্ষিত রেখেছেন এবং সে যা অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে তা অর্জনে সাহায্য করেছেন, হৃদয়কে মজবুত রেখেছেন এবং তার উদ্বেগ দূর করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন: (অর্থের ব্যাখ্যা)
"যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট" [আল-তালাক
65: 3]
অর্থাৎ, তার আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব বিষয় যেগুলো তার উদ্বেগের কারণ
হয় সেসবের জন্য তিনিই যথেষ্ট
হবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার হৃদয়ের শক্তি তিনি বৃদ্ধি করে দেন, ফলে সে কখনো কোন
কাল্পনিক বিষয় বা কোন ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবে না। কারণ সে তখন বুঝতে পারে এগুলো
মানুষের প্রকৃতি, দুর্বলতা এবং ভয়ের
ফলাফল যেসবের আদৌ
কোন ভিত্তি নেই। সে এটাও জানে, যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাঁর উপর ভরসা করে, তিনি তাদের জন্য যথেষ্ঠ
হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই সে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং তাঁর দেয়া ওয়াদার মাঝে মনের প্রশান্তি খুঁজে পায়, এবং এভাবে তার
চিন্তা ও উদ্বেগ অপসারিত হয়; কষ্ট-বিষণ্ণতা আনন্দে পরিণত হয়, ভয় শান্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করি যেন তিনি আমাদের নিরাপদ রাখেন, হৃদয়ের শক্তি এবং দৃঢ়তা দান করেন, তাঁর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করার তৌফিক দান করেন, কারণ
আল্লাহর উপর যারা ভরসা করে তাদের জন্য আল্লাহ উত্তম বিনিময় এবং সব ধরনের ক্ষতিকর বিষয় থেকে দূরে রাখার অঙ্গীকার করেছেন।
যদি খারাপ কিছু ঘটে যায় বা এ ধরনের আশংখা দেখা দেয়, তাহলে
আপনার উচিত ইতোমধ্যেই আধ্যাত্মিক
এবং পার্থিব উভয় বিষয়ে আপনি কত নেয়ামত
উপভোগ করছেন তার কথা
চিন্তা করা এবং এর সাথে আপনার সাথে ঘটে যাওয়া মন্দ
বিষয়টির তুলনা করা। যখন আপনি দেখবেন
আপনার সাথে ঘটা মন্দের তুলনায় এসকল নেয়ামতের সংখ্যা এত বেশি যে মন্দ দিকগুলো সেসময় আপনার তুচ্ছ মনে হবে।
[দেখুন শাইখ 'আবদূর রহমান ইবনে সা’দী রচিত “আল-ওয়াসাইল আল-মুফিদাহ লিল-হায়াত আল-সা’য়িদাহ]
ইবন আল-কায়্যিম সংক্ষেপে পনেরটি উপায় সংকলিত করেছেন যার মাধ্যমে আল্লাহ আপনার উদ্বেগ এবং অনুশোচনা দুরীভূত করতে পারেন, যা নিম্নরূপ:
১। তাওহীদ
আল-রুবুবিয়্যাহ (আল্লাহর একক কর্তৃত্বে বিশ্বাস)
২। তাওহীদ
আল-উলুহিয়্যাহ (আল্লাহকে একক ইলাহ হিসেবে
বিশ্বাস)
৩। জ্ঞান ও
বিশ্বাসের তাওহীদ (অর্থাৎ, তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, আল্লাহর
গুণবাচক নাম ও গুণাবলীর একত্বে বিশ্বাস)
৪। আল্লাহকে
তাঁর বান্দাদের উপরে অবিচার করার ঊর্ধে চিন্তা করা অর্থাৎ তাঁর বান্দাদের প্রতি
তিনি কোন অবিচার করতে পারেন না এবং বিনা কারণে তিনি কাউকে শাস্তি দেন না।
৫। ব্যক্তির
এটা বুঝতে পারা যে তিনিই আসলে ভুল করেছেন।
৬। আল্লাহকে
সেই নামে ডাকা যেগুলো তাঁর সবচেয়ে প্রিয়,
অর্থাৎ তাঁর গুণবাচক নামসমূহ। দুইটি নাম আছে যেগুলোর মাধ্যমে অন্য সকল নাম ও
গুণাবলিকেও বুঝানো হয়ে যায়। যেগুলো হচ্ছে আল-হাই (চিরঞ্জীব)
এবং আল-কাইয়্যুম (শাশ্বত)।
৭। শুধুমাত্র
এক আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।
৮। তাঁর কাছেই
দৃঢ়তার সাথে আশা পোষণ করা।
৯। সত্যিকার ভাবেই তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং প্রত্যেকের নিয়তি একমাত্র তাঁরই হাতে, তিনি যা
ইচ্ছা তাই করতে পারেন, তাঁর সকল ইচ্ছাই
অনিবার্যভাবে পূরণ হয় এবং তিনি
সর্বক্ষেত্রেই ন্যায়বিচারক; একথা মেনে নেয়া।
১০। নিজের
মনকে কুর’আনের বাগানে ছেড়ে দেয়া, যে কোন দুর্যোগে এখান থেকেই সান্ত্বনা খোঁজা, হৃদয়ের সব রোগের জন্য এখান থেকেই নিরাময় অনুসন্ধান
করা। যাতে করে এটি তার উদ্বেগ এবং দুঃখ কষ্ট দূর করে প্রশান্তি বয়ে
আনে।
১১। ক্ষমা
চাওয়া
১২। অনুতপ্ত
হওয়া
১৩। জিহাদ
১৪। সালাত
১৫। একথার ঘোষণা দেয়া যে, তার
নিজের হাতে আসলে কোন ক্ষমতা বাশক্তি নেই বরং যার হাতে
এগুলো আছে তাঁর হাতেই ছেড়ে দেয়া।
আমরা
আল্লাহর নিকট দু’আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে ক্লেশ এবং উদ্বেগ থেকে নিরাপদ রাখেন।
কারণ তিনি সদা শ্রবণকারী, দু’আর
জবাবদানকারী এবং তিনি শাশ্বত ও চিরঞ্জীব।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
মূল লেখাঃ শাইখ
মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত