পৃষ্ঠাসমূহ

"আমার ঈমান কি আমার কাছে ফিরে আসবে?"



প্রশ্নঃ কিছু বছর ধরে আমি ইসলাম পালন করে আসছিলাম কিন্তু কয়েক মাস ধরে আমি অনুভব করছি যে আমার হৃদয় ও অন্তরে ঈমান ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। এই বিষয়টা আমাকে পীড়িত করছে এবং আমি নিজেকে বললাম যে সম্ভবতঃ এটা শয়তানের ধোঁকা অথবা এইরকম কোন কিছুর কারনে হয়েছে এবং রমাদান আসলে এটা চলে যাবে। কিন্তু এটা চলে যায় নি এবং আমি দেখছি যে আমার কিয়ামুল লাইল (রাত্রিকালীন সালাত) আদায় করতে কষ্ট হচ্ছে। এই ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) সত্ত্বেও আমি অধিক কুরআন পড়তে চেষ্টা করেছি এবং এই কুমন্ত্রণা আমার ক্ষতি করে চলছে। আমার অবস্থা আমাকে সামাজিকভাবে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে এবং আমার দ্বীনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই কারনে আমি নিদারুন কষ্টের মধ্যে আছি এবং আমার ঈমানকে খুঁজে পাচ্ছি না, যেন তা আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে যে আমার একটা খারাপ সমাপ্তি হবে এবং আমার ঈমান আর কখনো ফিরে আসবে না এবং আমার হৃদয়ে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। আমি মসজিদে সালাত আদায় ছাড়িনি – কিন্তু যখনই আমি মসজিদে যাই, আমার মনে হয় যে আমি অন্য ইবাদতকারীদের মত নই এবং আমি তাদের ঈমানের কারনে তাদেরকে ঈর্ষা করি। আমার আরো মনে হয় যে আমার দ্বীন আমার থেকে চলে গিয়েছে এবং খুব কষ্ট করা ছাড়া আমার কুরআন অথবা হাদীস অথবা আলেমদের লেকচার টেপ শোনা হয় না। আমি আগের মত হতে চাই, একজন মুমিন যে দ্বীনকে ভালবাসে কারণ তা সত্য দ্বীন কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে আমি আমার অন্তর অথবা আমার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমি আমার গুনাহ সম্পর্কে চিন্তা করা শুরু করেছি যেটি আমার বিশ্বাস যে আমার এই অবস্থার কারণ এবং আমি অনেক গুনাহের কথা মনে করতে পারছি যেগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম, যেন তারা একের পর এক আমার সামনে আসছে। এখন পর্যন্ত আমি এইরকম কষ্ট, দুর্দশা ও যন্ত্রনার মধ্যে আছি। আমি জানিনা আমার কি হয়েছে এবং এর প্রতিকার ও সমাধান কি। , নাকি এটা হবে একটা খারাপ সমাপ্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি? সবশেষে, অনুগ্রহ করে আমার জন্য দুয়া করতে ভুলবেন না।


উত্তরঃ  সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য

আমার ভাই, আল্লাহর উপর ভরসা করুন এবং শয়তানকে সুযোগ করে দিয়েন না যাতে সে আপনাকে আল্লাহর সেই সীমাহীন করুণা থেকে হতাশ করতে পারে যেটি তিনি তার ঈমানদার বান্দাদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আপনি যেটিকে লক্ষণ মনে করছেন যে আপনি এমন অবস্থায় মারা যাবেন যাতে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট নন – প্রকৃতপক্ষে এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) মাত্র এবং তার কু-পরিকল্পনা যার দ্বারা সে আল্লাহর বান্দাদের প্রলুব্ধ করতে চায় এবং তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে নিতে চায়। তাই সে একজন ন্যায়নিষ্ঠ বান্দার কাছে আসে এবং তাকে বলে যে তার ভাল কাজগুলো কোন কাজে আসবে না অথবা সে এগুলো আল্লাহর জন্য করছে না বরং লোক দেখানোর জন্য করছে যাতে তারা মনে করে যে সে ভাল লোক। এ সবই আল্লাহর বান্দাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য শয়তানের সাধারণ পন্থা, বিশেষতঃ তাদের কর্মকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য যাদের মাঝে ন্যায়নিষ্ঠ হবার লক্ষণ পাওয়া যায় – আমি মনে করি আপনি তাদের মাঝে একজন, যদিও আমি কাউকে আল্লাহর সামনে প্রশংসা করি না।


আপনাকে আল্লাহর উপর আশা এবং ভরসা বাড়াতে হবে যিনি সকল গুনাহ মাফ করেন এবং যিনি তাঁর বান্দার দোয়া কবুল করেন যখন সে তাঁর নিরাপত্তা ও আশ্রয় কামনা করে, কারণ তিনি পরম দয়ালু, বারবার ক্ষমাশীল এবং সর্বাপেক্ষা স্নেহশীল।


আপনার উচিত আপনার সৎ কাজগুলো বাড়ানো যেমন কুরআন পাঠ, দান করা, আল্লাহকে স্মরণ করা (জিকর), আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ইত্যাদি। যে দুর্বলতা আপনি অনুভব করেন তা অন্যের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে কারণ এটা স্বাভাবিক। এরুপ কত লোকের উদাহরণ আছে যাদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যম ছিল, অতঃপর বহু সময় ধরে তারা এই আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যম হারিয়ে ফেলেছিলেন, এরপর আল্লাহর অনুগ্রহে তা আবার তাদের কাছে ফিরে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর প্রতি মনোনিবেশ করুন,


“প্রতিটি বস্তুরই জোয়ার আছে, আবার প্রতিটি জোয়ারেরই ভাটা আছে। এখন সেই আমলের অধিকারী ব্যক্তি যদি সোজা পথে চলে এবং প্রান্তিকতা ছেড়ে মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করে চলে, তবে তার সাফল্যের আশা করতে পার। আর যদি তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা হয়, তবে তাকে গণনা করবে না।”


(আত-তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত, হাদীস নং ২৪৫৩; শাইখ আলবানী সহীহ আত-তিরমিযীর ১৯৯৫ এ বলেন হাদীসটি হাসান)


“প্রতিটি বস্তুরই জোয়ার আছে” – এর অর্থ হল কোন কিছু করার আগ্রহ, উদ্যম এবং ভাল কাজ করার আকাঙ্ক্ষা।

“প্রতিটি জোয়ারেরই ভাটা আছে” – এর অর্থ হল ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা।


“কিন্তু যদি একজন লোক মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করে” – এর অর্থ হল উদ্যমী ব্যক্তি তার কাজ মধ্যমপন্থায় করে এবং যখন সে কর্মে উদ্যম বোধ করে, তখন চরমপন্থা পরিহার করে এবং শিথিলতা বোধ করলে সে অমনোযোগী হয় না।

“তার সাফল্যের আশা করতে পার” – এর অর্থ, আমার আশা আছে যে সে সফল হবে, কারণ সে মধ্যমপন্থায় অটল থাকে এবং আল্লাহর কাছে সেই আমলই প্রিয় যা ধারাবাহিকভাবে করা হয়।


“আর যদি তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা হয়” – অর্থ, যদি সে কঠোর পরিশ্রম করে এবং ভাল কাজ করতে চরমপন্থা অবলম্বন করে যাতে সে তার ইবাদত ও কঠোর সাধনার কারণে বিখ্যাত হতে পারে, এবং সে বিখ্যাত হয়ে যায় এবং লোকেরা একে অন্যকে তার দিকে ইশারা করে, তাহলে “তাকে গণনা করবে না” -  অর্থ, মনে কর না যে সে লোক দেখানো কাজ করেছে। তিনি বলেননি, “তার জন্য আশা কর না” – এটা এই দিকে ইঙ্গিত করে যে সে তখনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে এবং সে যা থেকে ব্যর্থ হয়েছে তা আর পূরণ করতে সক্ষম হবে না।

[তুহফাত আল-আহওয়াদি থেকে সংগৃহীত]


এই হাদীসের ব্যাপারে চিন্তা করুন এবং আপনার নিজের এবং অপরের পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে দেখুন – আপনি সুস্পষ্ট সামঞ্জস্য দেখতে পাবেন। এই হাদীস থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে ব্যক্তি এমন পর্যায় অতিক্রম করে যখন তার অদম্য আগ্রহ, সঠিক লক্ষ্য এবং তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। এরপর হঠাৎ সে দুর্বল হয়ে যায় এবং লক্ষ্য, আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলে। যখন সে এই পর্যায়ে পৌঁছে, তাকে আরো কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যাতে সে ফরজ দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং হারাম (নিষিদ্ধ) বস্তু থেকে বেঁচে থাকতে পারে। যদি সে তা করে, তাহলে তার মাঝে আশা আছে যে সে সফলতা লাভ করবে এবং অগ্রসর হবে। কিন্তু যদি সে হারামে পতিত হয় এবং ফরজ দায়িত্ব ছেড়ে দেয়, সে হারিয়ে যাবে ও ধ্বংস হবে।


সুতরাং আপনাকে অধিক পরিমাণে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে, তাঁর ক্ষমা অন্বেষণ করতে হবে এবং দুআ করতে হবে যাতে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আপনাকে অটল রাখেন। আমি আপনাকে আরো উপদেশ দেই যে আপনি হারাম থেকে বেঁচে থাকেন। আল্লাহ গুনাহসমূহ মাফ করুন এবং আপনার জন্য কাজকে সহজ করুন।

মূল লেখাঃ শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদঃ আল মালহামা অনুবাদক টিম কতৃক অনূদিত