পৃষ্ঠাসমূহ

‘ফিদায়ী অভিযানের’ বিষয়ে ইসলামের বিধান – শাইখ ইউসূফ ইবন সালেহ আল-উয়াইরী [পর্ব ২]


 এতসক্রান্ত বিষয়ের দলিলসমূহ:

আত্মোৎসর্গকারী ফিদায়ী আক্রমণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আলিমগণের রায় পর্যালোচনা কিংবা কিছু ভুল ধারণা অপনোদনের আগে আমাদের জন্য সমীচীন হবে এ সংক্রান্ত বিষয়ে শারীয়ার কিছু দলীল-প্রমাণ পেশ করা। এ দলীল-প্রমাণগুলি অনুসরণ করে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা এবং এর বাস্তব উদাহারণ তুলে ধরা। আমরা ক্রমসজ্জিত দলীলসমূহের প্রতিটির পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা করব  না , বরং বুখারী এবং মুসলিম শরীফকে মূল ভিত্তি করে অন্য হাদীসগ্রন্থগুলির রেফারেন্স উল্লেখ করব যা এ দলীলকে আরও বিশুদ্ধ প্রতিপন্ন করে।


একঃ
--------
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ ۚ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ ۚ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [٩:١١١]
“আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের থেকে তাদের জান এবং মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন; তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, হত্যা করে এবং নিহত হয়। তাওরার, ইনজীল ও কুরআনে এই সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর আছে? সুতরাং তোমরা সেই ব্যবসার জন্য আনন্দিত হও, যা তোমরা করেছ এবং এটাই তো মহা সাফল্য। ” ৯

সুতরাং এই আয়াতটিই আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে মুজাহিদদের পারস্পরিক দেনা-পাওনার মূল ভিত্তি। এই ব্যবসার জন্য মুজাহিদ ব্যক্তি যে মূল্যই দিতে প্রস্তুত থাকুক তাই অনুমোদনযোগ্য। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার কোন দলীল উপস্থিত না করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা নিশ্চিতভাবে জায়েজ।  

দুইঃ
--------
كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ [٢:٢٤٩]
"আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। ”  ১০

এই আয়াতটি নির্দেশ করে যে, শারীয়াহ অনুসারে শক্তির মাত্রা জাগতিক বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয়।  

তিনঃ
--------
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ [٢:٢٠٧]

"মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আত্মবিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তার বান্দাগণের প্রতি অত্যন্ত দয়াদ্র। ”   ১১

ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রহীমাহুল্লাহ) এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস (রদিআল্লাহু আনহু) এই আয়াতটি সম্পর্কে বলেন,

"এর অর্থ হল আল্লাহর হক্ব (তাওহীদ) প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে নিজেদের মৃত্যু  পর্যন্ত  জিহাদে অটল থাকার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদেরকে  আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। ”   ১২

ইমাম ইবনে কাসীর (রহিমাতুল্লাহ) বলেন,

"অধিকাংশ তাফসীরকারকগণ  মনে করেন, এই আয়াতটি আল্লাহর পথে জিহাদে রত প্রতিটি মুসলিমের জন্য নাযিল হয়েছে।... এবং হযরত হিশাম বিন আমের (রদিআল্লাহু আনহু) যখন কাফিরদের দুটি ব্যূহ ভেদ করে তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং একাকীই তাদের উপর আক্রমণ চালান, তখন কতক মুসলিম তার এই আক্রমণকে শারীয়াহ বিরোধী মনে করেন। কিন্তু হযরত উমার (রদিআল্লাহু আনহু) এবং হযরত আবু হুরাইরা (রদিআল্লাহু আনহু) প্রমুখ সাহাবীগণ (যারা এই আক্রমণকে শারীয়াহ বিরোধী মনে করেছিলেন) ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেন এবং এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন ।  ”  ১৩

ইমাম আল কুরতুবী (রহিমাতুল্লাহ) বলেন, "হাসান আল বাসরী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,

'তোমরা কি জান কাদের সম্পর্কে এই আয়াত নাজিল হয়েছে? এটি সেই মুসলিমদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে যারা কাফিরদের মুকাবিলা করে এবং বলে, 'তুমি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল, যদি তুমি তা বল, তাহলে তুমি এবং তোমার সম্পদ আমার পক্ষ থেকে নিরাপদ ' এবং কাফির যখন তা বলতে অস্বীকার করে তখন মুসলিমটি বলে 'আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আমি নিজেকে আল্লাহর কাছে বিক্রি করব।'  অতঃপর সে সামনে এগিয়ে যায় এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকে ” ১৪

উল্লিখিত সাহাবা (রদিআল্লাহু আনহু) কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসারে, যে আল্লাহর জন্য নিজেকে বিক্রি করে তার এই কাজকে কখনোই আত্মহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না, এমনকি সে যদি বর্ম পরিধান না করেই এক হাজার হিংস্র যোদ্ধার দিকে ধাবিত হয় এবং মৃত্যু বরন করে।  

চারঃ
--------
সূরা আল বুরূজে উল্লেখিত গর্তের মানুষদের সম্পর্কে সহীহ মুসলিমে জনৈক বাদশাহ এবং বালকের যে ঘটনাটি হাদিসে রয়েছে তা এ রকমঃ

"... অতঃপর জনৈক বালককে হাজির করা হল। তাকে বলা হল তুমি তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। সে প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর তাকে তার একদল লোকের হাতে দেয়া হল এবং বলা হল যে, এই বালককে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় উঠে যাবে।  যদি সে তার দ্বীন ত্যাগ করে তাহলে ভাল, নতুবা তাকে পাহাড় হতে  ফেলে দেবে । লোকেরা তাই করল। যখন তাকে নিয়ে তারা পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছে গেল তখন ঐ বালক দোয়া করল, হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে চাও, আমার বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপারে যথেষ্ট হয়ে যাও। অতঃপর পাহাড় প্রচণ্ডভাবে কেপে উঠল এবং ঝাঁকুনি দিল। এতে তারা সকলেই পাহাড় হতে পড়ে মারা গেল। বালক পায়ে হেঁটে বাদশাহর নিকট এল। বাদশাহ বলল, তোমার সাথে যারা গিয়েছিল তারা কোথায়? বালক বলল, তাদের হাত থেকে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। বাদশাহ আবার তার সৈনিকদের হুকুম দিল যে, এই বালককে একটি নৌকায় তুলে নাও, অতঃপর যখন সাগরের মাঝে চলে যাবে, তখন যদি সে দ্বীন ত্যাগ করে তাহলে ভাল, নতুবা তাকে সমুদ্রে ফেলে দাও। লোকেরা তাকে নিয়ে সমুদ্রের মাঝখানে চলে গেল। বালক বল, হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে চাও, আমার বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপারে যথেষ্ট হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে ঐ নৌকা উলটে গেল। ওরা সব মরে গেল। বালক হাঁটতে হাঁটতে বাদশাহর দরবারে চলে আসল। বাদশাহ বলল, ওহে! তোমাকে যারা নিয়ে গেল তারা কোথায়? বালক বলল, আল্লাহ তা'আলা তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন আর তাদের ধ্বংস করেছেন। এরপর বালক বলল, তুমি এভাবে চেষ্টা করে আমাকে মারতে পারবে না, যতক্ষণ না আমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ কর। বাদশাহ বলল কী সেই কাজ? বালক বলল, তুমি সব মানুষকে একটি বড় মাঠে জড়ো করবে এবং একটি উঁচু গাছে শুলিতে আমাকে চড়াবে,অতঃপর আমার তীরের থলি হতে একটি তীর বের করবে, এরপর তীরটিকে  ধনুকের রশিতে লাগাবে। অতঃপর বলবে, 'এই বালকের রব আল্লাহর নামে তীর নিক্ষেপ করছি।'  এভাবেই তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে। বাদশাহ তাই করল। সমস্ত মানুষকে একটি মাঠে জমা করল।অতঃপর বালককে গাছের শাখায় চড়ানো হল। এরপর বালকের তীরের থলি থেকে একটি তীর হাতে নিয়ে ধনুকের সাথে লাগালো। তারপর বলল, 'আমি এই বালকের রব আল্লাহর নামে তীর নিক্ষেপ করছি'। এই বলে তীর নিক্ষেপ করল। তীর গিয়ে বালকের মাথার একপাশে বিদ্ধ হল। অতঃপর বালক তার তীরবিদ্ধ স্থানে হাত রেখে মৃত্যু বরণ করল। এবং এভাবেই তার মৃত্যু ঘটল। এই ঘটনা দেখে লোকেরা বলে উঠল 'আমরা এই বালকের রব এর উপর ঈমান আনলাম। আমরা এই বালকের রব এর উপর ঈমান আনলাম।' বাদশাহকে তার লোকেরা গিয়ে জানাল, আপনি যা  আশংকা করেছিলেন তাই হয়েছে, মানুষতো সব ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে। বাদশাহ তার অনুসারীদের হুকুম দিলেন যে, প্রতিটি রাস্তার মুখে মুখে বিশালকার গর্ত তৈরি কর। বাদশাহর হুকুম অনুসারে প্রতিটি রাস্তার মুখে বিশাল আকারের গর্ত তৈরি করা হল এবং তাতে আগুন জ্বালানো হল। অতঃপর ঘোষণা করা হল 'যারা তাদের দ্বীন (ইসলাম) ত্যাগ না করবে তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ কর। তাই করা হল। এক পর্যায়ে এক নারীর পালা আসল। তার সঙ্গে ছিল তার দুধের শিশু। নারীটি যখন ইতস্ততঃ করছিল তখন তার দুধের শিশু মায়ের কোলে বসে বলল, 'মা তুমিও আগুনে ঝাপ দাও। নিশ্চয়ই তুমি হক্ব দ্বীনের উপর রয়েছো'  ” ১৫  

এই হাদিসে দেখা যায়, দ্বীনের স্বার্থেই এবং দ্বীনের কল্যাণের নিমিত্তেই এই বালকটি নিজেকে হত্যা করার উপায় বলে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল। এটি নির্দেশ করে যে, দ্বীনের স্বার্থে এরকম আত্মোৎসর্গ বৈধ এবং এবং তা আত্মহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয় না। স্মরণ রাখা দরকার, এরকম করার জন্য সে কোন ওহী পায়নি কিংবা তার এমন সিদ্ধান্তের পরিণতি কেমন হবে তাও সে আগে থেকে জানতো না । উপরন্তু, আমাদের শারীয়ায় বালকের এই ত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

পাঁচঃ
--------
ইমাম আহমাদ ইবনে আব্বাসের (রদিআল্লাহু আনহু) থেকে তার মুসনাদে ১৬  বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"মিরাজের রজনীতে যে রাতে আমাকে ভ্রমণ করানো হয় আমি একটি মনোমুগ্ধকর সুঘ্রাণ অনুভব করলাম। আমি বললাম হে জিবরাঈল! এত সুন্দর এই ঘ্রাণ কিসের? জিবরাঈল বললেন, এ হল ফিরআউনের কন্যার চুল আঁচড়ানো বাদী এবং তার সন্তানদের সুঘ্রাণ। আমি বললাম, এর কারণ কি? জিবরাঈল উত্তর দিলেন, একদিন তিনি ফিরআউনের মেয়ের মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিলেন ; হঠাৎ তার চিরুনিটি হাত থেকে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার সময় তিনি বিসমিল্লাহ বলেন। এই দৃশ্য দেখে ফিরআউনের মেয়ে বলল, তুমি কি আমার পিতার নাম উচ্চারণ করেছ? তিনি বললেন, না তোমাদের পিতা নন, বরং আমার এবং তোমাদের পিতার যিনি রব (আল্লাহ)। ফিরআউনের মেয়ে বলল, বাবাকে এটা বলে দিব কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ বল। মেয়ে গিয়ে ফিরআউনকে বলে দিল। ফিরআউন তাকে ডাকল এবং বলল, আমি ব্যতীত তোমার কি কোন রব আছে? তিনি বললেন, অবশ্যই তোমার এবং আমার রব আল্লাহ। একথা শুনে ফিরআউন পিতলের বড় হাড়িতে আগুন গরম করতে বলল। যখন হাড়ি গরম হয়ে গেল, তখন ফিরআউন তাকে এবং সন্তানদের ঐ উত্তপ্ত হাড়িতে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিল। তিনি বলল, তোমার কাছে আমার একটি দাবী আছে। ফিরআউন বলল, কি দাবী বল। তিনি বললেন, আমি চাই যে, আমার ও আমার সন্তানদের হাড্ডিগুলো একটি কবরে একত্রে দাফন করবে। ফিরআউন বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই এটি আমার প্রতি তোমার অধিকার।  এরপর তার সামনে তার সন্তানদের একে একে প্রত্যেককে সেই হাড়িতে নিক্ষেপ করা হল। এক পর্যায়ে তার দুধের শিশুর পালা আসল। এই নারী এবার একটু যেন বিচলিত হলেন। তখন দুধের শিশুটি বলল, মা তুমি দ্রুত ঝাপ দাও, কারণ এই পৃথিবীর শাস্তি আখিরাতের শাস্তির তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ। সঙ্গে সঙ্গে সে (নারী)  তাতে ঝাপ দিল। ” ১৭

পূর্ববর্তী "গর্তের লোকদের" ঘটনায় শিশুটি যেমন তার মাকে আগুনে ঝাপ দিতে বলেছে, এই হাদিসের ঘটনাটিতেও দেখা যায় শিশুটিকে আল্লাহ তা'আলা কথা বলিয়েছেন। দ্বীনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা যদি অনুমোদনযোগ্য না হত, আমাদের শারীয়ায় এই কাজটির এত ভূয়সী প্রশংসা করা হত না। আর এই শিশুটির কথা বলে উঠার বিষয়টি কুদরতি চিহ্ন ব্যতীত কিছু নয় যা এই কাজটির ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে।

ছয়ঃ
------
আসলাম আবি ইমরান হতে বর্ণিত,

"আমরা রোম শহরে ছিলাম। ওরা আমাদের উদ্দেশ্যে একটি বিশাল বাহিনী বের করল এবং মুসলমানদের থেকেও একটি বিশাল বাহিনী বের করা হল। মুসলিম বাহিনীর সৈনিকদের থেকে একজন ব্যক্তি অস্ত্র তুলে নিয়ে রোমানদের কাতারে ঢুকে পড়লেন। তখন কিছু লোক চিৎকার করতে লাগলেন যে, সুবহানাল্লাহ ! সে তো নিজেকে নিজের হাতে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। (এর দ্বারা তারা কুরআনের আয়াত, “তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।" এই আয়াতকে ইঙ্গিত করছিলেন।) তখন আবু আইয়ুব আনসারী (রদিআল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, "হে লোক সকল! তোমরা এই আয়াতের এই ব্যাখ্যা দিচ্ছ ! অথচ এই আয়াত নাযিল হয় আমাদের আনসারদের উদ্দেশ্যই । (ব্যাপারটা ছিল এই যে) যখন আল্লাহ তা'আলা ইসলামের বিজয় দান করে ইসলামকে মহিমান্বিত করলেন এবং ইসলামের সাহায্যকারীদের সংখ্যা অনেক হয়ে গেল, তখন আমাদের কিছু লোকেরা গোপনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম-কে  না জানিয়ে বলতে লাগল যে, আমাদের সম্পদ তো বিনষ্ট হয়ে গেছে। আর এখন তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা ইসলামের বিজয় ও সম্মান দান করেছেন , ইসলামের সাহায্যকারীও অনেক হয়েছে। সুতরাং এখন যদি আমরা আমাদের সম্পদ গুছানোর কাজে হাত দিতাম এবং আমাদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পুনঃগঠনে যদি মনোযোগ দিতাম ! তখন আল্লাহ তা'আলা তার নবীর প্রতি এ আয়াত নাযিল করে তার প্রতিবাদ করলেন,
وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ
"আর তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদের ধ্বংসের মাঝে নিক্ষেপ কর না। ”  ১৮

সুতরাং এখানে যুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া এবং সম্পদ পুনঃগঠনে আত্মনিয়োগ করাই ছিল ধ্বংস। যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সেনাদের মাঝে ঢুকে পরা ধ্বংস নয়। এরপর আবু আইয়ুব আনসারী (রদিআল্লাহু আনহু) সব সময় যুদ্ধের ময়দানেই কাটাতেন এবং শেষ পর্যন্ত কুস্তুনতুনিয়ায় তার দাফন হয় ।   ১৯

বায়হাকী-ও এটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তা শুনানের অপর এক বর্ণনায় "এককভাবে আল্লাহর শত্রুদের ঊমিতে লড়াই করার অনুমোদন" শীর্ষক অধ্যায়ে শত্রু দলের বিরুদ্ধে একাকী অগ্রসর হবার বিষয়টি অনুমোদনের দলীল হিসেবে পেশ করেছেন, এমনকি যদি এর ফলাফল এমনও হয় যে, এর ফলে শত্রু তাকে নিশ্চিত মেরে ফেলবে।

এই হাদিসে আবু আইয়ুব আনসারী (রদিআল্লাহু আনহু) এই আয়াতের (সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯৫) ব্যাখ্যা করেন যে, এটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যে ব্যক্তি শত্রু ব্যূহ ভেদ করে ঠেলে এগিয়ে যায়, যদিও লোকদের মনে এই ধারণা হয় যে, সে নিজেকে ধ্বংস করেছে। সাহাবাগণ মৌনভাবে তার এই ব্যাখ্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং গ্রহণ করেছেন।

সাতঃ
--------
মুআজ ইবনে আফরাহ (রদিআল্লাহু আনহু) বললেন,

"হে আল্লাহর রসূল ! কোন কাজ আল্লাহকে হাসায় ? ” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "বর্ম ব্যতীতই কারও শত্রুর মধ্যে ঢুকে যাওয়া। একথা শুনে তিনি তার শরীর হতে লোহার পোশাক খুলে ফেলে দিলেন এবং লড়াই শুরু করে দিলেন এবং এমন অবস্থায়ই তিনি শহীদ হয়ে যান।"  ২০

এই হাদীসটি এবং এর পরের আরেকটি হাদীস থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের অপারেশনের এমন বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বা নীতি রয়েছে যেখানে এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এতে কেউ কেউ নিহত হবে এবং এই বিশেষ নীতি অনুসারে এমন কিছু বৈধ যা সাধারণ অবস্থায় নিষিদ্ধ।

আনাস বিন মালিক (রদিআল্লাহু আনহু) এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,

“ইয়া রসূলুল্লাহ ! আমি যদি মুশরিকদের ব্যূহ ভেদ করে ঠেলে ভিড়তে ঢুকে যাই এবং যদি আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করে যাই আমি কি জান্নাতে যেতে পারব ?” নাবী সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, হ্যাঁ !। অতঃপর লোকটি মুশরিকদের ব্যূহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল এবং তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করে গেল ।" ২১    

আরও বর্ণিত আছে যে, ওহুদের দিনে উমর ইবনে খাত্তাব (রদিআল্লাহু আনহু) তার ভাই যায়েদ বিন খাত্তাবকে বললেন যে,

"আমার ভাই ! তুমি আমার বর্ম নাও। " যায়েদ উত্তরে বললেন, "আমি সেই শাহাদাত কামনা করি যা তুমিও কামনা কর । ”  সুতরাং তারা উভয়ই সকল বর্ম পিছনে রেখে দিল। ”  ২২

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------

৯. সূরা আত-তওবাহঃ ১১১
১০. সূরা আল-বাকারাহঃ ২৪৯
১১. সূরা আল-বাকারাহঃ ২০৭
১২. তাফসীর ইবনে আবি হাতীম (১/৪৩)
১৩. তাফসীর ইবনে কাসির (১/২১৬) এবং ইবনে শায়বার মুসান্নাফ (৫/৩০৩, ৩২২) এবং শুনান আল বায়হাকী (৯/৪৬)
১৪. তাফসীর আল কুরতুবীর এই আয়াতের ব্যাখ্যা
১৫. মুসলিম (১৩০) এটি তার কিতাবের শব্দ। আহমমাদ কর্তৃকও তা  উদ্ধৃত হয়েছে (৬/১৭)। আর-তিরমিযী (৩৪০) এবং আন-নাসাঈ "তুহফাত আল আশরাফ" (৪/১৯৯)। পুরো হাদিসের জন্য এবং এর ব্যাখ্যার জন্য আত-তিবয়ান পাবলিকেশন্স এর "দি পিপল অব ডিচ" বইটি দেখা যেতে পারে।
১৬. আল মুসনাদ (১/৩১০) এবং অনুরূপ বর্ণনা ইবনে মাজাহ তেও (৪০৩০) রয়েছে ।
১৭. ইমাম আহমাদ সাকির (রহীমাতুল্লাহ) তার 'তাহকীক অব আল-মুসনাদ' (৪/২৯৫,২৮২২) গ্রন্থে একে সহীহ বলেছেন।
১৮. সূরা আল বাকারাহঃ ১৯৫
১৯. আবু দাউদ (৩/২৭) এবং আত তিরমিযী (৪/২৮০) (আত তিরমিযী এটিকে সহীহ রায় দিয়েছেন) এটি বর্ণনা করেছেন এবং আল- আলবানী তার "আস-সিলসিলাহ আস-সাহিহাহ" (১৩) এবং 'সহীহ আত তারগীব' (১৩৮৮) গ্রন্থে এটিকে সহীহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরও দেখুন আল ওয়াদি " আল-জামি আস সাহিহ' (৩/২০০, ৪/১২৬, ৩৫৭,  ৩৮১, ৫/৪২২, ৪২৩, ৪৮২) এবং 'আস সাহিহ আল মুসনাদ' ( ১৪০,৩২৭) অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে ইবনে হাজাম এর 'আল মুহাল্লা' (৭/২৯৪) এবং ইবনে হাজার এবং 'আল ইসাবাহ' (৩/১২২) তে। আরও দেখুন ' ফাতহ আল বারী' (৮/৩৩-৩৪)  
২০. ইবনে আবি শায়বাহ এর 'মুসান্নাফ' (৫/৩৩৮)। এবং অন্য একটি বর্ণনায়, 'বদরের দিন যখন লোকেরা যুদ্ধ করার জন্য উপনীত হল, আউফ ইবনে আল হারিস বললেন, “ হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহকে বান্দার কোন কাজটি হাসিয়ে থাকে?” তিনি উত্তর দিলেন  'তিনি যখন তার বান্দাকে কোন বর্ম ব্যতীত শত্রুর ভিতরে ঢুকতে দেখেন। অতঃপর আউফ ইবনে আল হারিস তার বর্ম ফেলে দিলেন এবং তিনি এগিয়ে গেলেন এবং শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। আশ শাওকানি তার  'নাইল আল আওতার' (৭/২১২) এবং ইবনে হাজার তার 'আল-ইসাবাহ' (৩/৪২) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।    
২১. হাকীম কর্তৃক বর্ণিত। ইমাম আশ-শাওকানীর 'নাইল আল আওতার' (৭/১২১) দ্রষ্টব্য।
২২. আত তাবারানীর কর্তৃক বর্ণিত এবং আল হায়সামির '' শাহাদাতের পরে' অধ্যায়ে 'মুজমা আজ-জাওয়ায়ীদ' গ্রন্থে বর্ণিত। এবং আল-হায়সামি বলেন, তাবারানী দ্বারা বর্ণিত এবং বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য "। ইবনে আবদিল বার এর "আল-ইসতিয়ার” দ্রষ্টব্য।  
 

 ইনশা আল্লাহ চলবে...

অনুবাদঃ সংগৃহীত