পৃষ্ঠাসমূহ

পরভূমে...

২০১২ সালের বসন্তকাল। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের দত্তখেলের নিকটবর্তী দোগা গ্রামের একটি শান্ত উষ্ণ বিকাল। মেইনরোড থেকে সেনাবাহিনীর দ্রুতগামী গাড়িগুলোর আওয়াজে নিরবতা ভেঙ্গে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি বেষ্টনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেললো। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল মধ্যখেল ট্রাইব থেকে একজন ওয়াজিরির বাসগৃহ যিনি প্রতিবেশীদেশ আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত আছেন বলে জানা গেছে। কেউ জানে না কেন সেনাবাহিনী তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।


স্থানীয় গ্রামবাসীগণ মনে করলো সেনাবাহিনী সীমালঙ্ঘন করছে। তাই সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার আগেই গ্রামবাসীগণ তাঁদের অস্ত্র তুলে নিল, লক্ষ্য স্থির করলো বেষ্টনীর দুর্বল অংশের উপর এবং তাঁদের কর্তুজ খালি করলো জলপাই রঙের সবুজাভ গাড়িগুলোর দিকে যেগুলো গ্রামটিকে ঘিরে আবর্তন করছিল। আসন্ন বন্দুকযুদ্ধে সেনাবাহিনীর নাইন ডিভিসনকে রক্তস্নাত করানোর পর ওয়াজিরিগণ অক্ষত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলো। বেষ্টনীর চার্জে থাকা অফিসার আহত অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিল বেষ্টনী প্রত্যাহার করার। সেনারা যখন পশ্চাদপসরণ করছিল, তখন তারা দেখতে পেল একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তাঁর লাঠিতে ভর দিয়ে স্থানীয় মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। লোকটি দৃশ্যত তাঁর আশি বছরের হবে, তিনি সচরাচর শুনতে পান না। যখন তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে তাঁর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, যিনি মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে ঘটতে থাকা বন্দুকযুদ্ধের ও আরপিজির শব্দ শুনতে পান নি, পিছু হটতে থাকা সৈন্যরা তাকে তুলে নিল এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে তাদের গাড়ীর পিছনে তুললো। দত্তখেল ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে তাদের ত্বরিত প্রস্থানের সময় সেনা কনভয় দুজন অল্পবয়সী ছেলে দেখতে পেল যারা মেইনরোড অতিক্রম করেছিল। সেনাবাহিনীর জন্য আরো দুটি সহজ লক্ষ্য, যার সামরিক মহিমা আটজন মৃত ও চারজন আহত সৈনিকের কারণে সৃষ্ট ক্ষত মুছে দিচ্ছে। ঐ দুজন ছেলে যাদের একজনের বয়স তের বছর এবং অপর জনের চৌদ্দ, তাদেরকেও ধরা হল এবং ধাক্কা দিয়ে গাড়ীর পিছনে পাঠানো হল। কয়েক মিনিটের মধ্যে নাইন ডিভিসনের সৈন্যরা রক্তাক্ত অহংকারের সাথে তিনজন নির্দোষ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এল যাদের কারোই যুদ্ধ করার মত বয়সী নয়। তারপর জিজ্ঞাসাবাদে বৃদ্ধ লোকটি তাঁর ‘অপরাধ’ স্বীকার করলো যে, সে ঐ তরুণ লোকের পিতা যে কিনা সেনাবাহিনীর সার্চ অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু ছিল। দরিদ্র লোকটি – যে অজ্ঞাত ছিল এই বিদেশী বাহিনীর প্রতিশোধমূলক আচরণের শাসন সম্পর্কে - সে নিজের নিষ্কলুষতা নিয়ে নিজেই নিজের মৃত্যুর পরোয়ানা স্বাক্ষর করেছে।
 
পরদিন সকালে, দত্তখেল থেকে দোগাগামী রাস্তার পার্শ্বে স্থানীয়রা তিনজনের দেহ পঁচে যাওয়া অবস্থায় পেল। তিনজনের একজন হল আনুমানিক আশি বছরের দাঁড়িওয়ালা লোকটি, যার চক্ষু উপড়ানো ছিল, তাঁর দেহ ছুরির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ছিল। বাকী দুটি দেহ রাখা ছিল অল্প বয়সের দুটি ছেলের যারা টিনএজের শুরুতে প্রান হারাল। তাঁদের গলিত দেহও বলছিল অত্যাচারের জঘন্যতম পদ্ধতির একটি ভয়ানক গল্পঃ উপড়ে ফেলা চক্ষু, সারা দেহ ছুরিকাঘাতের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা, এসিডে পোড়ানো। এই অত্যাচারের দৃশ্য ছিল খুবই বেদনাদায়ক, এমনকি অন্যান্য কঠিন হৃদয়ের ওয়াজিরিদের জন্যও কষ্টকর ছিল। আশ্চর্যের এটি বাকি ছিল সেনাদেরকে কিসে এধরনের বিনা বিচারে নৃশংসতায় জড়িত করতে বাধ্য করলো? অবজ্ঞাপূর্ণ দাম্ভিকতা এবং ‘রক্তাক্ত বেসামরিক বসতি’ মনে বদ্ধমূল করলো PMA কে আলাদা ভাবে, তাঁদের নির্যাতন হচ্ছে একদম স্পষ্ট ভয়ানক যা মেরুদন্ডে শিহরণ জাগানোর মত। সর্বশেষ আমি ইতিহাস বইয়ে স্পেনের তদন্ত প্রসঙ্গে কিছু নির্যাতনের কথা পড়েছিলাম। ঐ তদন্তকারীরা কি তাদের কবর থেকে উঠে এসেছে যাকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করা হয় তার পোষাকের ভেতর দিয়ে যে, এই অত্যাচারের পদ্ধতি প্রস্তাব করতে? অথবা এটি কি একটি নোংরা সমার্থক ধারা যা FCR এর সাথে যৌথ নির্যাতন হিসেবে? যদি তাই হয়, ইসরাইলীদের উচিত PMA পরিদর্শন করা এবং প্যালেস্টাইনীদের উপর আরো অধিক কার্যকরী শাস্তি প্রয়োগ করতে এখান থেকে একটি বা দুটি শৈল্পিক ধারার নির্যাতনের অধ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করা।

সেনাবাহিনীর পাশবিকতা, বাংলাদেশ থেকে লাল মসজিদ পর্যন্ত, মানুষকে হতবুদ্ধি করে দেয়। কি করে স্পষ্টত সুসভ্য ও সুপরিচ্ছন্ন অফিসার ও সৈন্যরা এত নিম্নস্তরে নামতে পারে? কিন্তু যেটি সর্বাধিক হতবুদ্ধিকর তা হল অযথা বর্বরতা যা এসব পাশবিকতাকেই নির্দেশ করে, তা আরো এবং আরো তীব্র হবে যত আপনি উপজাতীয় কেন্দ্রস্থলে পৌঁছবেন। সৈন্যদের কিছু অংশ সোয়াতে নৃশংসভাবে বয়স্ক লোকদেরকে নির্যাতন করছে, তাঁদের বয়স ৪০, ৫০ ও ৬০ এর ঘরে, তারা একজন দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধকে গলায় দড়ি বেঁধে টানছিল যেখান থেকে রক্তের দাগযুক্ত মুখ দেখা যাচ্ছিল তাঁর, এবং সারকথা হিসেবে মালাকান্দের টিনএজারদের ফাঁসির কথা বলা যায় যা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটছে, এগুলো পাকিস্তানে ঘাত প্রতিঘাত ও সহিংসতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু যা একচোখা মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে তা আরো বেশি জঘন্য।

গত বছরের ডিসেম্বরে ইশা চেকপয়েন্টে কিছু সেনার মৃত্যুর প্রতিহিংসাবশত তিরিশ জন ট্রাক ড্রাইভার মীর আলি বাজারে লক্ষ্যবস্তু ছিল এবং পরিশেষে সেনাদের দ্বারা ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাদের। মালাকান্দে তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীলতার অপরাধ দেখিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষদেরকে কয়েকশত ফিট উপরে ভাসতে থাকা হেলিকপ্টার থেকে জীবন্ত ছুড়ে ফেলা হত। ২০০৯ সালে মেহসুদ অপারেশনের সময় যৌথ অপারেশনের আংশিক নীতি হিসেবে সেনাবাহিনী দ্বারা কয়েকশত গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা হয়। ২০০৯ সালেই মাকিন থেকে সারারোঘা পর্যন্ত মেহসুদের বাজারগুলো ধ্বংস করা হয় বিমান বাহিনীর বিমান হামলার মাধ্যমে। এমনকি রাহ-এ-আজব অপারেশন শুরু করার পূর্বে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, মীর আলি বাজার আর্টিলারী শেলিং দ্বারা ধূলিস্মাত করে দেয়া হয়। বর্তমান অপারেশনের সময় দীগনে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এবং মুজাহিদীনগণ এলাকা ত্যাগ করার পর সেনাবাহিনীর দ্বারা দীগন বাজারও মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। যা খুব বেশি বিরক্তিকর তা হল যদিও এটি একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, তথাপি এখানে মসজিদগুলো এবং মাদ্রাসাগুলো সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আছে। সেনা অভিযানের সময় সোয়াত, মালাকান্দ, মেহসুদ, বাজাউর, মোহমান্দ, ওরাকজাই, এবং খাইবারে শত শত মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল বিমানবাহিনী। একই রকম নির্দোষদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার কূট কৌশল উত্তর ওয়াজিরিস্তানে আবার পুনরায় ঘটছে।
 
গ্রামগুলো পুড়িয়ে ফেলা, মসজিদগুলো ধ্বংস করা এবং বাজারগুলো ধূলিস্মাত করে দেয়া, গোটা উপজাতীয় বলয়ের ভূপ্রকৃতিকে লন্ডভন্ড করে দেয়া এসবকিছু অভিযোগের সাথে একই প্রশ্ন করছেঃ যারা জন্মলগ্ন থেকে ৬৫ বছর পাকিস্তানের কোন ক্ষতি করে নি তাদেরকে কেন এসব অংশ (তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী অথবা জঙ্গী থাকার অভিযোগ করা) সাব্যস্ত করা হচ্ছে?

হতে পারে এর উত্তর নির্ভর করছে বৃটিশ আমল থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বংশানুক্রমিক মানসিকতার উপর, উপজাতীয় এলাকার উপর এসব আচরণে মনে হচ্ছে যেন এটি ‘এলাকায়ে-গাইর’; পরভূমি। এই উপজাতিদের চিত্র যেমন ‘পর’ এটি আমাদের মনে গভীরভাবে বদ্ধমূল হয়েছে, এসব একে বাধ্য করে আরো গৌরবময় অতীতে ফিরে যেতে। এর শিকড় চলে যায় বৃটিশ রাজের দিনগুলোতে, যখন তথাকথিত সামরিক ঘোড়-দৌড়বাজ সেনারা রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দিয়েছিল সমতল পাঞ্জাব থেকে যাতে তারা সম্মুখের স্বাধীন অঞ্চলগুলো দখল করতে পারে, যা শতবছর ধরে সেখানে আহবান করছে, যাতে বৃটিশ শাসিত নির্দিষ্ট জেলাগুলোর প্রত্যেক বৃটিশ তাদের অধীন ও অংশ করার চেষ্টা করে। রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মির পাঞ্জাবি সেনারা সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টস এর অন্তর্ভুক্ত হল। উত্তরের বাজাউর থেকে দক্ষিণের ওয়াজিরিস্তান পর্যন্ত তারা তাদের বৃটিশ প্রভূদের সাথে নিয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে IPI এর ফকির মোল্লা পাউইন্দাহ এর বাহিনী এবং মুজাহিদীন আন্দোলনের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলো। পাঞ্জাব ও FF রেজিমেন্ট এর অধিকাংশ যুদ্ধের রং, মেডেল ও সম্মাননা অর্জিত হয়েছিল এসব যুদ্ধের দ্বারা ইংল্যান্ডের রানীর নামে। উপজাতীয় এলাকার উপত্যকা ও পাহাড়গুলোতে শত শত দমন অভিযান ও কঠিন যুদ্ধ সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার ও রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মি শান্তিপূর্ণ উপজাতিদেরকে মুক্তি ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে পারে নি। তাই তারা পরিণত হল ‘অন্যান্য’ হিসেবে।

তারা আমাদের সবার মনে ‘অন্যান্য’ হয়েই রইল কারণ আমাদের পূর্বপুরুষগণ কেউ স্বেচ্ছায় অথবা কেউ জোরপূর্বক বৃটিশ সাম্রাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, যা ঐ উপজাতীয়রা করে নি। আমাদের পূর্বপুরুষগণ স্বেচ্ছায় অথবা জোরপূর্বক বৃটিশ রাজের ছায়ায় জীবন যাপন করতে সম্মত হয়েছিল; যেখানে তারা তাদেরকে বৃটিশ রাজত্বের অধীনে আনার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করেছিল সর্বশেষ বৃটিশ সৈন্য উপমহাদেশ ত্যাগ না করা পর্যন্ত। যখন পাঞ্জাবের এক নিম্নশ্রেণী অনেক বিস্তৃত ইউনিয়ন জ্যাক, যাকে তারা নিজ ভূমি বলতো, সেখানে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ করে দীর্ঘস্থায়ী গ্লানি ডেকে এনেছিল নিজেদের উপর, তখন উপজাতিগণ ইসলামের প্রতিরক্ষার্থে এবং এক আল্লাহর ওয়াস্তে যুদ্ধ করছিল। আমরা যেন ভূলে না যাই, রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মির আত্মসীকৃত ‘মুসলিম’ সেনারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান খিলাফত থেকে বের হতে ও প্যালেস্টাইন বৃটিশদের দখলে নেয়ার ব্যপারে জড়িত ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হংকং থেকে নরমান্ডী পর্যন্ত সম্মুখে থেকে মেডেল অর্জন করেছিল, এবং নানা উপায়ে রানীর জন্য তাদের জীবন ‘উৎসর্গ’ করেছিল।

উপজাতিগণ ‘অন্যান্য’, কারণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা-পূর্ব ইউনিটগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের বিরুদ্ধে বৃটিশ ভারতের সীমানা বৃদ্ধির উচ্চ আশা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং ‘প্রাদেশিক আজ্ঞা’ দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল, তারা এমন এক লোকদের হাতে কেবল পরাজিত হতে হতে ভুগছিল যারা কখনোই শাসক হিসেবে পরিচিত ছিল না। যেখানে মোল্লা পাউইন্দাহ এবং IPI এর ফকিরের মত তাদের সমর নায়কগন, সেখানে ‘আমাদের’ সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বীরদের উদাহরণ হচ্ছে জেনারেল মুসা খান, যে ওয়াজিরিস্তানে বৃটিশ অভিযানে সামনে থেকে দায়িত্বপালন করেছে, এবং তার নাম, যে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের মিরানশাহ এর নিকটের পাহাড়বেষ্টিত বয়া চেকপোস্ট ঐ দিন সুসজ্জিত করেছে।
তারা ‘অন্যান্য’ কারণ, পাকিস্তানের অনেকের অপছন্দনীয়, তারা তাদের আত্মাগুলোকে বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং ৯/১১ এর পর বলেছে ‘আমেরিকা প্রথমে’, এবং তের বছরের বেশি সময় ধরে অবিচলিতভাবে আমেরিকা, ন্যাটো এবং তাদের স্থানীয় আত্মস্বীকৃত পোষা কুকুর, যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আইএসআই, এমআই, বিমান বাহিনী ইত্যাদি, এদের গলার কাঁটা হয়ে আছে। এরা তারাই যারা ন্যাটো কন্টেইনার তাদের দেশের উপর দিয়ে পরিবহনে রাজি হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যেখানে আমাদের সেরা কিছু ব্যক্তি মুখেই প্রতিবাদ করতে পারে।
তারা ‘অন্যান্য’ কারণ তারা অগণিত ড্রোন হামলা, অসংখ্য সেনা অভিযান, আমেরিকা ও ন্যাটোর হুমকি এসব সত্ত্বেও মুজাহিদীনগণকে একদশকের অধিক সময় ধরে আপ্যায়ন করেছে, যেখানে পাকিস্তান এর স্থল ও আকাশসীমাকে ক্রুসেডারদের জন্য ফ্রি-জোন হিসেবে পরিণত করেছে।

কিন্তু এটিই কি সত্য যা আমরা অবচেতনভাবে গ্রহণ করছি? আমি সন্দিহান। পাকিস্তানে একজন ব্যক্তি বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে যা শুনতে পায় তা বিভিন্ন কাহিনী। অপরাধের আখড়া, ডাকাত, খুনী, প্রতারক, চোর, গাড়ী ছিনতাইকারীদের নিরাপদ স্বর্গ, উপজাতিগণের ব্যাপারে এসব নিগূঢ় তথ্য এবং আরো আছে...। কিন্তু এক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। কেউ কি আছেন যিনি সাধারণ এলাকার সাথে উপজাতীয় এলাকার অপরাধের মাত্রা, যেমন... চুরি, খুন, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ এবং গাড়ী ছিনতাই... এসব অপরাধের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক চিত্র নিয়ে কখনো মাথা ঘামান? গাড়ী ছিনতাই, চুরি, খুন এবং মুক্তিপণের জন্য অপহরণ এসব অপরাধের আখড়া হিসেবে আমাদের মেগাসিটিগুলো দেখিঃ লাহোর, করাচি, পেশোয়ার এবং রাওয়ালপিন্ডি। সার্বজনীন ধারণার বিপরীতে, পাকিস্তান থেকে বেশির ভাগ ছিনতাই হওয়া গাড়ী উপজাতীয় এলাকায় গিয়ে পাওয়া যায় নি, বরং এগুলোকে সাধারণ এলাকাগুলোর পাশেই পাওয়া গেছে, বিশেষত সোয়াবি, নওশেরা এবং কোয়াত, এবং তাদের স্পেয়ারপার্টসগুলো বড় শহরগুলোর স্পেয়ারপার্টস এর দোকানে বিক্রয় করা হয়েছে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং আমার মত শত শত অন্যান্যদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি দৃঢ়তার সাথে এ দাবি করতে পারি যে, উপজাতীয় এলাকাগুলো সাধারণত এবং বিশেষ করে ওয়াজিরিস্তান পাকিস্তানের সর্বনিম্ন অপরাধ প্রবণ এলাকা। কেন? কারণ আপনারা এখানে পাঞ্জাবের পুলিশদেরকে পাবেন না। এখানে কোন অপরাধ সংঘটিত হয় না কারণ উপজাতীয় বলয়ে কোন পুলিশ স্টেশন নেই। আপনি শান্তিপূর্ণ একটি জায়গায় একটি পুলিশ স্টেশন স্থাপন করুন, আপনি শীঘ্রই দেখবেন অপরাধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে। পুলিশ সেখানেই সাফল্য লাভ করে যেখানে অপরাধও সাফল্য লাভ করে। অপরাধ তাদের পকেটে সবদিক থেকে টাকায় পূর্ণ করে দেয়। শূন্য মাত্রার অপরাধ যে সমাজে বিদ্যমান সেখানে পুলিশের প্রয়োজন নেই। আরেকভাবে বলা যায়, পুলিশের ঐ সমাজকে প্রয়োজন নেই যেখানে অপরাধের মাত্রা শূন্য। এটি তাদের টিকে থাকার প্রশ্ন।

আপনি সেখানে অপরাধ পাবেন না তার আরেকটি কারণ এটি একটি সশস্ত্র সমাজ। আসলে এটি সশস্ত্র হওয়ার আগে এটি একটি ‘সমাজ’। এটি আমাদের শহরগুলো থেকে পৃথক একটি পৃথিবী যেখানে আমাদের শহরগুলোতে সকল সামাজিকতা দুভাগ করা হয়েছে টাকার মিথ্যা প্রভু ও জড়বাদ দ্বারা। আমাদের শহরগুলো দখল করেছে অকর্মণ্যরা যারা তাদেরকে প্রকৃত জগত থেকে রক্ষা করতে চারদিকে নিজস্ব নকল বাস্তবতা সৃষ্টি করে। এটি একটি নকল জগত যেখানে আপনি চলন্ত এটিএম থেকে আগত একজন মানুষের সাথে কথা বলতে পারবেন না। আর বিষয়গুলোকে জঘন্য করতে দুই ধরনের অপরাধীদের অস্ত্রের উপর একচেটিয়া অধিকারঃ এক হচ্ছে ইউনিফর্ম পড়া যারা নীলনকশার রাষ্ট্রনীতির চতুর্দিকে ঘুরে,(যদি সে একজন বড় ধরনের অপরাধী হয়, তারপরও একজন জলপাই সবুজাভ হিলাক্স) এবং অপর অস্ত্রধারীরা হচ্ছে ক্ষুদ্র চোর ও ডাকাত, যাদের অধিকাংশ সময়ই ম্যাগাজিনে বুলেট থাকে না এবং তারা দুইবার তাদের বন্দুক লোড করবে, যদি তিনবার না করে, তাহলে বুঝতে হবে তাদের নির্দোষ(পড়ুন অজ্ঞ) শিকারকে ভয় দেখাতে এরকম করছে।

উপজাতিদের মধ্যে বাজাউর থেকে ওয়ানা পর্যন্ত এলাকার মানুষজন সবচেয়ে ধন্য মানুষ শুধু এই দেশেরই নয় বরং সারা পৃথিবীর মধ্যেই। তারা আমার জীবনে দেখা সর্বাধিক জনসেবী মানুষ, পাশাপাশি তারা সৎ, নির্ভেজাল এবং সাহসী। তারা আমাদের শহুরে সংস্কৃতির মত নয়, তারা একে অন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অতিথিকে অধিক আপ্যায়নের ক্ষেত্রে, এমনকি অতিথিকে সমাদর করতে সৌজন্যমূলক যুদ্ধ করে, যেখানে আমরা সৌজন্যতার অভাববশত প্রায়ই পরোক্ষভাবে অতিথিকে প্রশ্ন করিঃ আপনি কি এখানে আসার আগে খেয়ে এসেছিলেন নাকি আপনি এখান থেকে যাওয়ার পর খাবেন। তারা এমন এক সম্মানিত ও গর্বিত মানুষ, যারা ইসলামকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এবং ইসলামের জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন করতে দ্বিধা করে না। এখানে উপজাতীয় সমাজের ব্যপারে একটি অন্তর্নিহিত ভালো দিক আছে যেখানে সর্বত্রই উপজাতি ও উপজাতীয় সমাজ বৈশ্বিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ইসলামের উপর নির্ভর করেছে এবং তারা মুজাহিদীনগণকে আশ্রয় দিয়েছেন। এটি একটি অতিমানবীয় বিষয় যা আমরা মালি, সোমালিয়া, ইয়েমেন থেকে আফগানিস্তানে এবং পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় পুনর্বার ঘটতে দেখছি। বিস্ময়ের কিছু নেই, এই কৃত্রিম জীবনের যেসব চিহ্ন আমরা আমাদের শহরগুলোতে ক্যান্সারের মত বেড়ে যেতে দেখি সেই আমেরিকার বৃহত্তম মিশ্র সংস্কৃতির প্রবক্তারা দেখছে করাচি, ইসলামাবাদ, লাহোর, রিয়াদ অথবা কায়রো থেকে হুমকি আসছে না, বরং তা আসছে ওয়াজিরিস্তান, আবিয়ান, মালি, এবং সোমালিয়ার উপজাতীয় পশ্চাদ্ভূমি থেকে। এটি ঐসব মুসলিম দেশসমূহের উপজাতীয় অঞ্চল যেগুলো নব্য-ক্রুসেডার সেনাবাহিনীর ও তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধান লক্ষ্য। এমনকি যেমন আমাদের সমাজ এ যুদ্ধে অনীহা ও সংশয় দ্বারা প্লেগাক্রান্ত হয়েছে, তেমনি আমাদের শত্রুরা ‘অন্যান্য’ দেরকে চিহ্নিত করতে ভূল করে নি যা এর জন্য হুমকি। আমাদের শত্রুরা শত্রু থেকে বন্ধু প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় নি। এটি জানে মুসলিম সমাজের মধ্যে ঠিক কোথা থেকে এর বৃহৎ পরিকল্পনার হুমকি আসে এবং এটি খুঁজে বের করছে এটি যেমন ‘গৃহ ভৃত্য’ শ্রেণী থেকে বিশ্বাসযোগ্য মিত্র, যা অব্যর্থভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বৃহৎ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।
কাজেই, যতক্ষণ না আমরা সঠিক ‘অন্যান্য’ দেরকে চিহ্নিত করতে না পারবো যা আমাদের মধ্যেই অবস্থান করছে, যা প্রতিরক্ষামূলক আবাসন সমাজ নির্মাণ করে উন্নতি করছে আমাদেরই ট্যাক্সের মাধ্যমে, যা এর নিজ লোক ব্যতীত অন্য কোন শত্রুকে চিনে না, যার একটি নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য রয়েছে নিজের লোকদেরকে শিকার করার যারা একে ৬০ বছর ধরে অকাতরে বাঁচিয়ে রাখছে, এবং আমরা যতদিন না এর শত্রুদের মুখোশ পড়ে আমাদের সাথে প্রতারণার ও ভন্ডামির ভান উন্মোচন করছি, ততদিন আমরা আমাদের নিজেদের লোকদেরকে খুন হতে দেখব এবং এবং তাদের শহর ও গ্রামগুলো কমতে কমতে ধ্বংস হয়ে যাবে।
 
এখনই সময় আমাদেরকেও সাহস সঞ্চয় করতে হবে শত্রু থেকে বন্ধু প্রমাণ করার জন্য।

মূল লেখাঃ -আম্মার খান
অনুবাদঃ সংগৃহীত via Resurgence বাংলা