পৃষ্ঠাসমূহ

একটি ক্ষয়িষ্ণু ব্যবস্থাকে 'ইসলামিক' করার প্রচেষ্টা? (১ম পর্ব)



বর্তমানে আমরা একটি যুগের ক্রান্তিকাল পার করছি। যেকোনো যুগের শেষে, ভবিষ্যৎ হয় সাধারণত অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন। যদিও এই অস্পষ্টতার মধ্য দিয়েই একটি বিষয় সোজাসুজিভাবেই বলে দেওয়া যায় যে পুঁজিবাদ আর বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে তার গতি ধরে রাখতে পারবেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলস্বরুপ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার অন্তিম মুহুর্তে পৌছে গিয়েছে।

পুঁজিবাদের মুল কথা হচ্ছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদ ,একটি সমাজ বা একটি রাষ্ট্র যার পিছনে শুধুমাত্র পুঁজি আহরনের নিমিত্তেই পুঁজি আহরন করার "প্রজ্ঞা' কাজ করে। একজন ব্যক্তি যিনি এই ভিত্তির উপর নিজের কর্মসমুহকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে, পৃথিবীতে মানুষের ছলনাময় কত্রিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার অনুষন্ধান এ ব্যস্ত থাকে,তিনিই মুলত একজন পুঁজিবাদী।

এটা মোটেও জরুরি নয় যে তাকে সম্পদশালী হতে হবে।উসমান বিন আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন অত্যন্ত ধনী কিন্তু তিনি একজন পুঁজিবাদী ছিলেন না।একইভাবে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে শেঠ ওয়ালী ভাই ও (খিলাফত আন্দোলনের,১৯১৯-১৯২৩,¬পরিচালনা পরিষদ এর প্রধান) একজন অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু পুঁজিবাদী ছিলেন না।
পুঁজিবাদ এর মুল স্বরুপ হচ্ছে,পুঁজি হচ্ছে সম্পদের অন্যায় ব্যবহার এর ফল। যখন সম্পদের মুল উদ্যেশ্যে হয়ে যায় অসীম পরিমানে বর্ধিতকরন এর সম্পদ হয়ে যায় পুঁজি। এই অর্থে পুঁজি হচ্ছে লোভ ও লালশার বস্তুগত রুপ। একজন পুঁজিবাদী এ দুটো রোগের দাশ (আবদ আদ দিরহাম ওয়াদ দিনার)। একজন পুজিবাদী বিস্বাস করে যে সম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে ক্রমাগত এর পরিমান বৃদ্ধি করে যাওয়া।তাই প্রত্যেক কর্মজীবী, কৃষক ও সহায় সম্বলহীন পুজিবাদী এই 'প্রজ্ঞা'কে মেনে নেওয়ার সাথে সাথেই তার চরম দারিদ্রতার পরও নিজেকে পুঁজিবাদী হিসেবে সাব্যস্ত করলো।

একটি পুঁজিবাদী অন্তরের সাথে সবচেয়ে ভাল মিল পাওয়া যায় এমন একটি সমাজের যা 'উপযোগবাদী' মুলনীতিগুলো গ্রহন করেছে। যেহেতু পুঁজি আহরন ব্যতীত কামনার অন্ধ অনুকরণ সম্ভব নয়,একটি পুজিবাদী সমাজ হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যার ব্যক্তি পর্যায় হতে শুরু করে সামষ্টিক পর্যায়ে কর্মগুলো সম্পাদন হয় মুলোতো একটা উদ্যেশ্যেই আর সেটা হচ্ছে সরবোচ্চ পরিমান পুঁজি উত্তোলন করা। পুঁজিবাদী সমাজের বাজার নামে একটি স্বত্তা থাকে যা সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে কত্রিত্বশীল।একটি পরিবারে সন্তানদের পড়ানো হয় যাতে তার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরিমান পুঁজি উত্তলোন করা যায়। একটি পরিবারের বিবাহের প্রস্তাবগুলো আসে মুলোত 'ভাবী' বর ও কনের অর্থনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখে।প্রতিটা কাজের মুল্য নিরুপন হয় মুলত 'অর্থ' ও পুঁজিবাজার এর ভিত্তিতে।পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যা যথারীতি 'সভ্য সমাজ' নামে পরিচিত, এখানে 'ধর্মের' সম্পুর্ন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

একটি সভ্য সমাজে ব্যক্তির কাজের মুল্য নিরুপন ধর্মের 'বানী' বা নির্দেশ এর দাড়া করা হয়না বরং তার(ব্যক্তির) অর্থ পুঞ্জিভূত করার উপর নির্ভর করে এ বিষয়টি।পুজিবাদী সমাজের সর্বোচ্চ গুরুত্ববহ বিষয়টি নির্ধারণ করা হয় 'দাম' দ্বারা যা বাজার নির্ধারণ করে দেয়।

একটি পুঁজিবাদী সমাজে( যেমন লিবারেল ডেমিক্রেসি) সভ্য সমাজ সমৃদ্ধিসাধন করে কিছু প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে। যেমন
১) বিস্বাসের স্বাধীনতা
২) ব্যক্তি স্বাধীনতা যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে পরিচালনা করে এবং সে যেকোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত এবং সে মুক্তভাবেই তার পছন্দনীয় চিন্তাকে গ্রহন বা বর্জন করতে পারে।
৩) সমতার নীতি যেখানে সকল ব্যক্তিই সমান এবং এই দুষ্ট ব্যক্তি পুজার স্বত্বে স্বত্বাধিকারী।
৪) সহিষ্ণুতা যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করা উচিৎ।
এসকল মুলনীতিগুলো গঠন করা হয়েছে মুলত আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব কে ভিত্তি করে যা একজন মুমিনের বিস্বাসের দুটি মুলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
১) প্রথমত, মানুষ আল্লাহর 'আবদ' বা গোলাম যেখানে 'মর্ডানিস্ট'দের মতে মানুষ একটা আত্নপ্রত্যয়ী ও সনির্ভর সত্বা যার 'সৃষ্টিকর্তার' প্রয়োজন নেই।
২) জীবনের মুখ্য উদ্যেশ্য হচ্ছে শর্তহীন ও পুর্নরুপে আল্লাহর নিকট নিজেকে সপে দেওয়া আর তথাকথিত 'মর্ডানিস্ট'রা মনে করে জীবনের উদ্যেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেওয়া।

যেখানে আমরা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' তে বিস্বাস করি তারা মানুষকেই দৈব ক্ষমতা প্রদান করে রেখেছ। যেহেতু পুঁজিবাদ একটি ব্যবস্থা হিসেবে 'modernist ideals' কে ধারন করার চেষ্টা করে, এটা বলা ভুল হবে না যে পুঁজিবাদের 'মর্মবাণী' হচ্ছে 'লা ইলাহা ইল্লা' ইনসা' অর্থাৎ মানুষ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং পুঁজিবাদ মুলত আল্লাহ (সুবা) তার রসুলগন(আ:) এবং যত 'ইব্রাহীমী' দ্বীন আছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে।
যদিও পুঁজিবাদের উত্থান হয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে, পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদী শক্তির রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়(যেখানে আমারিকার মুল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ান্দের সুকৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়) এটি সন্ত্রাসী রুপ ধারন করে এবং স্থিতি লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিস্বে আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয় (যদিও পুঁজিবাদী কখনোই ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার এ সফল হয় নি)

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে পুজিবাদের পতন আরম্ভ হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির সম্মুখীন আজ পুঁজিবাদ তা হলো বুদ্ধিবৃত্তি। যে 'মর্ডানিস্ট' ও 'বুদ্ধিবৃত্তিক' দর্শন পুঁজিবাদ কে আধিপত্যের চুড়ায় নিয়ে যায় তা যুক্তিবলে 'ভ্রান্ত' বলে প্রমানিত হয়। যেসকল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন পুঁজিবাদের 'পৌরাণিক গাথা' বিনির্মাণের জন্য দায়ী সেগুলাকে 'পোস্ট মর্ডানিজম' বলা হয়।

পোস্ট মর্ডানিজম' এর মুলত প্রবক্তাগন ছিলেন মিচেল ফুকাল্ট[১], দেরিদ্দা[২], লিওটার্ড [৩] ও রর্টি' [৪]। 'মর্ডানিজম' পরবর্তী বুদ্ধীজীবিরা যুক্তি দিয়ে প্রমান করে যে পুঁজিবাদের মুল বিস্বাস যেমন 'স্বাধীনতা' ও 'প্রগতি' এসব অসারই নয় অসম্ভবপরও বটে।বাস্তবতা হচ্ছে এই যে একটি পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন হয়। সকল কিছু ভাষা নিয়ে খেলাই হয়ে যায়। কোন কাজই তা ব্যক্তিগত হোক বা সামষ্টিক হোক তার সাথে 'বিস্বাসের' কোন সম্পর্ক থাকে না। তাই পুঁজিবাদী ব্যক্তিত্ব সমসময় বিভেদে রত থাকে। 

চলবে ইনশাআল্লাহ...

(১) Michel Foucault (মৃত্যু. ১৯৮৪) ফরাসি দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং সাহিত্য সমালোচক।
(২) Jacques Derrida (মৃত্যু. ২০০৪) ফরাসি দার্শনিক যিনি theory of deconstruction তত্ত্বের জন্য খ্যাত।
(৩) Jean Francois Lyotard (মৃত্যু. ১৯৯৮) ফরাসি সাহিত্যিক যিনি তার "Articulation of Post-modernism" এর জন্য খ্যাত।
(৪) Richard McKay Rorty (মৃত্যু. ২০০৭), মার্কিন দার্শনিক।


মূল লেখাঃ  ড. জাভেদ আনসারি
অনুবাদঃ সংগৃহীত via  Resurgence বাংলা